অাদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইমামদের ভূমিকা
ইমাম অর্থ নেতা, অগ্রবর্তী ব্যক্তি, পথপ্রদর্শক, গুরু বা পরিচালক। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রাপ্তবয়স্ক সমাজের গ্রহণযোগ্য সম্মানিত সৎসাহসী ব্যক্তি, যার কুরআন তেলাওয়াত সহি ও শুদ্ধ, যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেন ও নামাজের মাসআলা-মাসায়েল জানা দ্বীনদার মুত্তাকি, যার কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের মৌলিক ধারণা আছে, সমাজকে নেতৃত্ব দানে সক্ষম, তিনিই মুসলিম সমাজের ইমাম হবেন এবং মসজিদে নামাজের ইমামতি করবেন। বিশ্বনেতা আল্লাহর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ তাই নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রতিটি কথা, কাজ ও ভাষণ বা খুতবা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। মুহাম্মদ সা: খুতবায় যে বক্তব্য দিতেন, তা মানুষকে জানানো-শেখানো ও উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে ছিল। খুতবা নিঃসন্দেহে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য। হ্যাঁ, এমনই ভাষণ প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: মদিনার মসজিদে দিয়েছিলেন। তাঁর খুতবা থেকে মানুষ পেত শিক্ষা, নিত দীক্ষা। ‘খুতবাতে মুহাম্মদী গ্রন্থ’ মতে রাসূল সা: জীবনে প্রায় ১১ শ’ খুতবা দান করেন। নবী সা:-এর খুতবার পদ্ধতি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, হৃদয়গ্রাহী, ঈমানদীপ্ত ও অনুসরণীয়।
মানবতার মুক্তির দূত নবীকুলের শিরোমণি মুহাম্মদ সা:-এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত ওসমান রা: ও হজরত আলী রা: যেভাবে সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন তথা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং মসজিদে নামাজের ইমামতি করেছেন, তা ছিল সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় সমাজের মডেল। তাদের সময়কালে ইমামের কথায়ই সমাজ পরিচালিত হতো এবং সমাজে শান্তি বজায় ছিল।
কিন্তু চলমান সমাজে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। শতকরা ৮৮ ভাগ মুসলমানের এই দেশে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইমাম নিয়োগ করা হয়। মাসিক বেতনের বিনিময়ে তিনি মসজিদে নামাজ পড়ান। তাই মসজিদ কমিটির সভাপতি বা সম্পাদককে খুশি করতে তাদের পছন্দমতো জুমার খুতবা বা ভাষণ প্রদান করতে হয়। কমিটির লোকজন যে পন্থী বা যে আদর্শের অনুসারী সে পন্থানুযায়ী বয়ান দেন। ইমাম সাহেব নিজের চাকরি ঠিক রাখতে, বেতন বাড়াতে কমিটির সন্তুষ্টি অর্জনে এসব করে থাকেন।
দুঃখের বিষয়, দেশের কী হলো বা সমাজের কী পরিবর্তন এলো সে দিকে এসব ইমামদের নজর নেই। এ ছাড়া আজ যুবসমাজ ধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, সমাজ অশ্লীলতায় ভেসে যাচ্ছেন এসব যেন ইমাম সাহেবের ভাষণের বিষয় নয়। আর হবেই বা কেন? ইমাম সাহেব তো সমাজের নেতা কিংবা পরিচালক নন। তিনি মসজিদে চাকরি করেন মাত্র।
জুমার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের সূরা আল জুমার ৯ নম্বর আয়াতে দু’জাহানের মালিক মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য দ্রুত যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।’
জুমার দিনের ফজিলত ও নির্দেশনা প্রসঙ্গে হজরত আবু লুবাবা ইবনে আবুল মুনযির রা: বর্ণনা করেন, আমি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে বলতে শুনেছি যে জুমার দিন সপ্তাহের সব দিনের সর্দার, আল্লাহ তায়ালার কাছে অন্য সব দিনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত দিন। এই দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা অপেক্ষা অধিক মর্যাদাবান। এই দিনে পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম আ:-কে সৃষ্টি করেছেন। এই দিনেই তাকে জমিনে নামিয়েছেন এবং এই দিনেই তাকে মৃত্যু দিয়েছেন। এই দিনে এমন এক মুহূর্ত আছে যে মুহূর্তে বান্দা আল্লাহ তায়ালার কাছে যা চাইবে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে তা দিবেন। এই দিনে কেয়ামত সংঘটিত হবে। সে জন্য সব নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা, আসমান-জমিন, পাহাড়-সমুদ্র, আলো-বাতাস সবাই জুমার দিনকে ভয় করে। হজরত আউস ইবনে সাকাফি রা: বলেন, ‘আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি- যে মুসলমান জুমার দিনে উত্তমরূপে গোসল করে অতি প্রত্যুষে মসজিদে হেঁটে যায়, সাওয়ারিতে আরোহণ করে না, ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে এবং মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনে, খুতবার সময় কোনো কথা না বলে, তবে সে জুমার জন্য যত কদম হেঁটে আসে তার প্রতিটি কদমের জন্য সে এক বছর রোজা রাখার সওয়াব এবং এক বছর রাতে ইবাদত করার সওয়াব পাবে।’
জুমা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুমিনের জন্য জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন’ (ইবনে মাজাহ)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে জুমার দিনটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনের মতো শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদাসম্পন্ন’ (ইবনে মাজাহ)।
বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘হে মুসলমানগণ, জুমার দিনকে আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য (সাপ্তাহিক) ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তোমরা এ দিন মিসওয়াক করো, গোসল করো ও সুগন্ধি লাগাও’ (মুওয়াত্তা, ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত : এক ইহুদি তাঁকে বলল, ‘হে আমিরুল মুমেনিন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা আপনারা পাঠ করে থাকেন, তা যদি আমাদের ইহুদি জাতির ওপর অবতীর্ণ হতো, তবে অবশ্যই আমরা সেই দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম!’ তিনি বললেন, ‘কোন আয়াত? সে বলল, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম’ (সূরা মায়েদা : ৩ )।
উমর রা: বললেন, ‘এটি যে দিনে এবং যে স্থানে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা জানি; তিনি যেদিন আরাফার ময়দানে গিয়েছিলেন আর সেটা ছিল জুমার দিন’ (বুখারি ও মুসলিম)।
উল্লিখিত তাৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতময় এই জুমাবারের প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদিসে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আমাদের জীবনে ও চলমান সমাজে বাস্তবায়ন করতে ইমামদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা প্রতিপালনে অবদান রাখতে হবে। ঈমান ও ইসলামের খালেস মনোবাঞ্ছা নিয়ে ইমামতি করতে হবে, খোদা নাখাস্তা তা যেন শুধু চাকরির জন্য না হয়। ঈমান ও ইবাদতের খাতিরে জুমার খুতবায় সমাজ পরিবর্তনের সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। একজন ঈমানদার মুসলমান হিসেবে সত্যের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমামকেই প্রথম সারিতে এগিয়ে আসতে হবে। ইমাম হিসেবে এ কাজ আপনার জন্য সহজ। ইমামেরা একটু কৌশলী হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর খেদমতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতি-বিচ্যুতি বিপথগামী মুসলমানদের সামনে তুলে ধরুন এবং কুরআনের পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করুন। আলোকিত সত্য সুন্দর মানুষ তৈরিতে অবদান রাখুন।
লেখক : ইসলামী গবেষক।
৪০৪
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। গবেষণার মাধ্যমেই অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা এবং......
مفتاح الجنة الصلوة. অর্থ : নামায বেহেশতের চাবি। -মিশকাত শরীফ,......
সবর করা নবীর শিক্ষা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর......
এক দেশের এক ইমামের কথা। ইমামের বড় ছেলেটার বয়স দশ......
গবেষণা করে কি হয় তা এক কথায় উত্তর দেয়া কঠিন।......
সমাজ সংস্কারে ইমামদের ভূমিকা ইমাম,খতীব মুসলমানদের মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও......
পাপ শরীরকে ভারী করে জনৈক ব্যক্তি হাসান বসরি রহ.কে বলল,......
হিংসার অপর নাম ধ্বংস অন্যের ভালো কিছু দেখে নিজের মনে......
হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ (রা:) নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু......
দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা মুহাম্মদ সোলাইমান কাসেমী সকল সৃষ্টির......