মহানবী হযরত মুহাম্মদ
মুস্তফা (সা.) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.] সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার
লক্ষ্যে একটি আদর্শ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করে সর্বাধিক কৃতিত্বের আসনে সমাসীন
হয়েছেন। যার প্রশস্তি সর্বকালের ও সর্বযুগের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের
মুখে মুখে বিধৃত। তিনি এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে পৃথিবীতে আগমন করেন যখন আরবের
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায়
পৌঁছে গিয়েছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা,
পাপাচার ও ব্যাভিচারে ভরপুর
ছিল তখনকার আরবীয় সমাজ। অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্ধ-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ
করছিল। বিশ্বমানবতার সেই ঘোরতর অন্ধকারে ভূ-পৃষ্ঠে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা নিয়ে ৫৭০
খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমিনার গর্ভে
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শুভাগমন ঘটে। তাঁকে শান্তি,
মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
সমাজে তাঁর শান্তি
প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত,
অরাজকতা দূরীভ‚ত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-স¤প্রীতির ভিত্তিতে তিনি একটি কল্যাণমূলক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
তিনি দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকলের মাঝে শান্তিচুক্তি এবং
সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত
শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কিশোর বয়সে তিনি ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক শান্তিসংঘ গঠন করে সামাজিক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ান। আর্তমানবতার সেবা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা
এবং গোত্রে গোত্রে স¤প্র্রীতি বজায় রাখা ছিল এ শান্তিসংঘের
অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর প্রথম
সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে তিনি
সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘœকারী সকল কার্যক্রম
প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিয়ে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ
করে সুশীল সমাজ গঠনে সচেষ্ট হন।
তৎকালীন আরবদের মধ্যে কোনো
ঐক্যবোধ বা জাতীয় চেতনা ছিল না। গোত্রপ্রীতির কারণে সমাজে কলহ-বিবাদ লেগেই থাকত।
তিনি এ কৃত্রিম ভেদাভেদ ও দ্বন্ধ-কলহের চিরতরে অবসান ঘটান। আরব সমাজে ‘দাসত্বপ্রথা’ মানুষে মানুষে চরম শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি
করেছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি সমাজ থেকে
দাসত্বপ্রথার বিলোপ সাধন করেন। তৎকালীন সময়ে কন্যাশিশুকে আরবে জীবন্ত মাটির নিচে
প্রোথিত করা হতো। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ জঘন্য প্রথা নিষেধ করেন। নারীদের অমর্যাদা ও
বিশৃঙ্খল জীবনযাপন আরব সমাজের অশান্তির কারণ ছিল। নারী জাতিকে নির্যাতন ও দুর্দশার
হাত থেকে উদ্ধার করে তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন,
‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ (আহমাদ,
নাসাঈ)
মদিনায় হিজরতের পর তিনি
সেখানে আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন। মানবেতিহাসের প্রথম
প্রশাসনিক ও লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদ’ -যাতে সেখানে বসবাসরত সব ধর্মাবলম্বীর স্বাধীনতা ও অধিকারের
যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ছিল। মদিনায় স্থায়ীভাবে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং তথায়
বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত ইহুদিদের সঙ্গে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন
করেন। এভাবে তিনি মদিনার জীবনে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে শান্তি স্থাপনের বলিষ্ঠ
উদ্যোগ নেন। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি সন্ধিচুক্তি
ভঙ্গকারী সন্ত্রাসীদের মদিনা থেকে বহিষ্কারের মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান
করেন, যা দেখে কারও পক্ষে সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত হওয়া সম্ভব
ছিল না। দয়ালু নবী হওয়া সত্তে¡ও সন্ত্রাস দমনপূর্বক সমাজে
শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন আপসহীন।
শত অত্যাচার-নির্যাতন ও
যুদ্ধ করে আজীবন যে জাতি তাঁকে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে,
সে জাতি ও গোত্রকে
সার্বজনীন ক্ষমা প্রদর্শন করে তাদের সঙ্গে উদার মনোভাব দেখিয়ে সমাজে
শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। কঠিন যন্ত্রণা-দুঃখ-কষ্ট-বেদনা সহ্য করে মাতৃভ‚মি থেকে বিতাড়িত হয়ে পাথরের আঘাত সয়েও তিনি
মানবতার জয়গান গেয়েছেন, সমাজের মানুষকে বিভ্রান্তির
অন্ধকার থেকে সত্য ও ন্যায়ের আলোর পথে চলার জন্য উদাত্ত আহŸান জানিয়েছেন। আজীবন অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সামাজিক শান্তি ও মুক্তির
জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। অভিশপ্ত দাসপ্রথা, যৌতুক প্রথাসহ সমাজের নানা ধরনের অনিয়ম এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন
সৈনিকের মতো লড়াই করেছেন।
ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও
প্রসারের পর তিনি বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে অসংখ্য চুক্তিপত্র স্বাক্ষর
করেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অনবদ্য ভ‚মিকার অনন্য স্মারক ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’; শান্তির স্বপক্ষে তিনি এ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ৬৩ বছরের মাক্কী ও মাদানী
জীবনে তিনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রিসালতের দায়িত্ব সূচারুভাবে
সমাপন করে গিয়েছিলেন। তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন যেমন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তেমনি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করেছেন সামাজিক শান্তি সুরক্ষার জন্য। জীবনে
অনেকগুলো আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে অথচ এর কোনোটিই
আক্রমণাত্মক যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে শায়িত বিধর্মীদের লাশকে তিনি শত্রæর লাশ নয়, মানুষের লাশ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং সে
অনুযায়ী যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন। এমনি হাজারো সব মহৎগুণে তাঁর আদর্শ জীবন ছিল
পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল সুমহান ব্যক্তিত্ব; ক্ষমা, উদারতা ও করুণার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি।
অন্যের দুঃখ-কষ্টে তাঁর হƒদয় কেঁদে উঠতো, মানুষের বিপদ-আপদে তাঁর
চিত্ত ব্যথিত হতো। সমাজে অভাবী, অনাহারী মানুষকে অকাতরে
তিনি দান করে গেছেন সর্বস্ব। নিজে ক্ষুধিত হয়েও সমাজে ক্ষুধার্ত মুসাফির, এতিম, মিসকিনকে তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের অন্নবস্ত্র।
চলমান বিশ্বসমাজ সংসারে
তাঁর ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুশাসন কায়েম হলে পরে পৃথিবীতে
কোনো প্রকার সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকতো না। প্রখ্যাত দার্শনিক
জর্জ বার্নার্ড শ’ সমস্যা-জর্জরিত
বর্তমান বিশ্বে সামাজিক শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোনো
ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন,
তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর
সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসতো বহু
বাঞ্ছিত শান্তি ও সুখ।’
রাসূলুলাহ (সা.) সর্বপ্রথম
বিশ্ববাসীকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ উপহার দিয়ে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং
নিরাপত্তার বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর অনুপম জীবনচরিত ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মধারা সব
মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক চিরন্তন আদর্শ। মানবজাতির মধ্যে
ভ্রাতৃত্ব-সংহতি ও সৌহার্দ্য-স¤প্রীতি সুরক্ষা এবং সমাজ
থেকে অন্যায়, অবিচার ও অসত্য দূরীভূত করে শান্তি
প্রতিষ্ঠায় তাঁর আজীবন প্রয়াস বিশ্বমানবতার জন্য মহান অনুপ্রেরণার উৎস। মানব সমাজে
পরিপূর্ণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করা
একান্ত বাঞ্ছনীয়। তাই নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, বিশ্বশান্তি ও কল্যাণের পথই
হল মহানবী (সা.)-এর অনুপম শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের মূল চেতনা। জগতে হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি,
শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও বিভ্রান্তি দূরীভূত হয়ে মানব
সমাজে শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী
(সা.) উদযাপনের মধ্য দিয়ে সর্বক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ বাস্তবায়িত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
১৬৭
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
বছরের বার মাসে ও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি......
বছরের বার মাসে ও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি......
মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.] সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে......
একটি সমাজ বা একটি রাষ্ট্র বা বিশে^র ভূ-মন্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায়......
মুহাররম মাস الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على نبينا......
সচ্ছলতা এবং দারিত্রতা আসার কারণদরিদ্রতা আসে সাত জিনিসের কারণেঃ.১। তাড়াহুড়া......
আত্মহত্যা কী? আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে......
মুহররম মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজার ফজিলতকাতাদাহ (রা:) এই আয়াতের......