পবিত্র যাকাত যাদের উপর ফরয হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে:
প্রিন্ট
প্রকাশঃ :
বৃহস্পতিবার ০৪/০২/২০২১
প্রশ্নঃ পবিত্র যাকাত যাদের উপর ফরয হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে:
(১) পবিত্র যাকাতদাতাকে মুসলমান হতে হবে। (২) বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক। (৩) আক্বেল বা বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন। (৪) আযাদ বা স্বাধীন। (৫) নিছাব অর্থাৎ সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য বা টাকা অর্থাৎ নিছাব পূর্ণ হওয়া। (৬) যদি এককভাবে কোন পণ্য বা দ্রব্যের মূল্য নিছাব পরিমাণ না হয় কিন্তু ব্যক্তির সবগুলো সম্পদের মূল্য মিলিয়ে একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান হয় তবে ওই ব্যক্তির নিছাব পূর্ণ হবে। অর্থাৎ নিছাবের একক মালিক হওয়া। (৭) সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণ কর্তনের পর নিছাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে পবিত্র যাকাত দিতে হবে। (৮) হাওয়ায়েযে আছলিয়ার অতিরিক্ত। (৯) বর্ধনশীল মাল যেমন- স্বর্ণ, চান্দি, নগদ টাকা, মালে তিজারত বা ব্যবসায়িক মাল এবং সায়েমা বা চারণ ভূমিতে বিচরণকারী পশু। (১০) বর্ষ পূর্ণ হতে হবে অর্থাৎ নিছাব পরিমাণ সম্পদ তার অধীনে পূর্ণ ১ বছর থাকতে হবে।
* স্বামী-স্ত্রীর সস্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্নহেতু পৃথকভাবে নিজ নিজ সম্পদের পবিত্র যাকাত আদায় করতে হবে।
* নির্ধারিত পবিত্র যাকাত পরিশোধের পূর্বেই সম্পদের মালিক মারা গেলে পবিত্র যাকাত পরিশোধের পর ওয়ারিশগণ মালিক বলে গণ্য হবে।
যাদের উপর পবিত্র যাকাত ফরয নয়:
ইয়াতীম ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক-বয়স্কা ছেলে হউক অথবা মেয়ে হউক তারা নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাদের উপর পবিত্র যাকাত ফরয হবেনা। নি¤েœ এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
নিছাব পরিমাণ মাল থাকার পর যদি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ঋণের পরিমাণ অধিক হওয়ার কারণে নিছাব না থাকে, তখন তার উপর পবিত্র যাকাত ফরয থাকে না বা হয় না।
হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ নিছাব পরিমাণ হলেও উক্ত সম্পদের উপর পবিত্র যাকাত ফরয হবে না। কারণ সম্মানিত ও মহাপবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার ফতওয়া মুতাবিক সে নিছাবের মালিক নয়। উক্ত সম্পদ থেকে পবিত্র যাকাত ছাড়া ছদকায়ে ফিতর, আদায় করলে এবং উক্ত সম্পদ থেকে পবিত্র কুরবানী করলে তা কবুল হবে না। উপরন্তু কবীরাহ গুনাহ হবে। যেমন: চুরি-ডাকাতী, ছিনতাইয়ের টাকা বা সম্পদ, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি পন্থায় অর্জিত সম্পদের ও তার মালিকের উপর কোন যাকাত নেই।
নিত্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা স্থাবর সম্পদের উপর কোন পবিত্র যাকাত নেই। সেটা নিছাব পরিমাণ হলেও তার মালিকের উপর যাকাত নেই।
ইয়াতীম ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পবিত্র যাকাত প্রদানের বিধান:
হানাফী মাযহাব উনার ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে, ইয়াতীম ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মাল নিছাব পরিমাণ হলেও তাদের উপর পবিত্র যাকাত উনার হুকুম বর্তাবে না। তবে উক্ত ইয়াতীম ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক-বয়স্কা ছেলে-মেয়ে যদি বালিগ-বালিগা হয় অতঃপর নেছাব পরিমাণ মালের মালিক হয় এবং তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়, এ অবস্থায় যদি ইন্তিকাল করে তখন ওয়ারিছগণ সর্ব প্রথম তাদের উক্ত পরিত্যাক্ত সম্পদ থেকে পবিত্র যাকাত আদায় করবে। অতঃপর ওয়ারিছগণ তাদের পরিত্যাক্ত সম্পদ বণ্টন করে নিবে। (হিদায়া)
মালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তাবলী:
মাল নিছাব (শরীয়ত নির্ধারিত) পরিমাণ হওয়া।
উক্ত মাল নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য ও স্থাবর মালের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া।
উক্ত মালের উপর পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া।
মালের উপর ব্যক্তির পূর্ণ মালিকানা থাকা।
মুদ্রা, টাকা বা ব্যবসায়ের পণ্য হওয়া।
পশুর যাকাতের ক্ষেত্রে পশু সায়িমা তথা বিচরণশীল ও বর্ধনশীল হওয়া।
ফসলের পবিত্র যাকাত তথা ওশরের ক্ষেত্রে, যমীনে উৎপাদিত ফসল কম-বেশি যাই হোক; (বিনা শ্রম ও সেচে) তার দশ ভাগের এক ভাগ অথবা (শ্রম ও সেচে) বিশ ভাগের এক ভাগ পবিত্র যাকাত দেয়া, আমাদের সম্মানিত হানাফী মাযহাবে ফসলের কোন নিছাব নেই।
যে সব মাল অর্থ-সম্পদের উপর পবিত্র যাকাত ওয়াজিব নয়:
বসবাসের ঘর।
পরিধেয় বস্ত্র।
ঘরের আসবাব পত্র।
আরোহণের পশু বা যানবাহন।
কাজের জন্য ভাতা প্রদত্ত দাস-দাসি তথা খাদিম-খাদিমা।
ব্যবহারের হাতিয়ার বা যুদ্ধাস্ত্র।
হারানো বা লোকসান যাওয়া মাল।
সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মাল।
ছিনতাই করে নিয়ে গেছে এমন মাল।
মাটিতে পুতে রাখা মাল-সম্পদ যার স্থান স্মরণে নেই।
ঋণ প্রদত্ত মাল যা গ্রহীতা বারবার অস্বীকার করেছে।
লুণ্ঠিত মাল।
ব্যবসার অযোগ্য মাল।
স্থানান্তরের অযোগ্য ও স্থাবর ধন-সম্পদ।
এক বছর পূর্ণ হয়নি এমন মাল।
ইয়াতীম, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও দাস-দাসীর মাল।
পবিত্র যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিছাব বছর পূর্ণ হওয়া আবশ্যক:
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-
“হযরত ইবনে উমর আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি কোন মাল লাভ করেছে, তা এক বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার ওই মালের পবিত্র যাকাত নেই।” (তিরমিযী শরীফ)
আরো বর্ণিত আছে- “হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করেন, কোন সম্পদের বছর পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বে পবিত্র যাকাত ফরয হবে না।” (আবূ দাউদ শরীফ ও বায়হাকী শরীফ)
বর্ষপূর্ণ হওয়ার পূর্বে পবিত্র যাকাত প্রদানের হুকুম:
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-
“হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আপন যাকাত বর্ষ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দেয়া সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে পবিত্র যাকাত প্রদানে অনুমতি দিলেন।” (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)
বছরের শুরুতে ও শেষে নিছাব ঠিক থাকলে এবং মাঝখানে কমলেও যাকাত দিতে হবে:
এ প্রসঙ্গে ফিকাহ ও ফতওয়ার কিতাবে ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উল্লেখ করেন, বছরের শুরু এবং শেষে তথা নির্ধারিত তারিখে নিছাব ঠিক থাকলে তাকে অবশ্যই পবিত্র যাকাত দিতে হবে, যদিও মাঝখানে কখনো নিছাব থেকে কিছু অংশ কমে যায়। এরপরও তাকে পবিত্র যাকাত আদায় করতে হবে। (কুদূরী, আল হিদায়া)
مصرف الزكوةঅর্থাৎ পবিত্র যাকাত পাওয়ার যারা হক্বদার:
নিম্নলিখিত আট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা ফরয হিসেবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
“পবিত্র যাকাত কেবল ফক্বীর, মিসকীন ও পবিত্র যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের জন্য অর্থাৎ নও মুসলিমের জন্য, গোলাম বা বাঁদীদের মুক্তির জন্য, ঋণে জর্জরিত ব্যক্তিদের ঋণমুক্তির জন্য, মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় জিহাদকারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা মহান আল্লাহ পাক উনার নির্ধারিত বিধান এবং মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৬০)