পথহারা ভাগ্যবান পথিক
ইয়ামামা নামক এলাকাটি বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের কাছেই। ওই এলাকারই শাসক ছিল ছুমামা ইবন উছাল। মুসলমানদের জঘন্যতম শত্রু।ইসলামের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে ছুমামা সবসময় অগ্রভাগে থাকত। আল্লাহর রাসূল সা.কে সে নাউজুবিল্লাহ হত্যা করার জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা.ও আল্লাহর দরবারে তাকে নিজের কাবুতে আনার জন্য দুআ করে ছিলেন।
.
একবার ছুমামা উমরার উদ্দেশ্যে বের হয়। তার সৌভাগ্য, সে পথ হারিয়ে মদিনার আশপাশে পৌঁছে যায়। রহমতে আলম হযরত মুহাম্মদ সা.এর নিকট কেউ যদি ভুলে চলে আসে তারও সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। স্থায়ী সফলতা ভাগ্যে জুটে যেতো ।
.
তখন মুসলমানদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন দল সবসময় মদিনার চারপাশে টহল দিত। সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তি, শত্রুপক্ষের কোনো গুপ্তচর অথবা কোনো কাফির খারাপ মতলবে মদিনা অভিমুখি হলেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা তার কুমতলব ব্যর্থ করে দিত।
.
ছুমামা প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি গ্রুপের হাতে গ্রেফতার হয়। যেহেতু এ লোকটি তার কুফরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং ইসলামের শত্রুতায় তার বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা গোপন ছিল না, তাই তাকে আটক করে মসজিদে নববির খুটির সাথে বেঁধে রাখা হলো।
.
ইসলামের এ শত্রুর আটকের খবর আল্লাহর রাসূল সা.কে পৌঁছানো হয়। তিনি আসেন। দেখলেন তাকে। লম্বাকৃতি, সুদর্শন চেহারা, সুঠামদেহ, পরিপূর্ণ বক্ষদেশ, উচুঁ গলা, বিস্ফারিত নয়ন, প্রতাপ-প্রতিপত্তি, কর্তৃত্বের ভাব, শান-মান...মোটকথা মন্দ শাসকদের সব দোষ তার ব্যক্তিত্বে স্পষ্ট।
.
রাসূলুল্লাহ সা. সামনে অগ্রসর হলেন। জিজ্ঞাসা করেন,
-“ছুমামা! কী অবস্থা? অবশেষে আমার রব-প্রতিপালক তোমাকে আমার নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিলেন।”
সে নিতান্ত রাগ ও অহমিকার সাথে উত্তর দিল,
-হে মুহাম্মদ! ঠিক আছে। বিষয়টা তো এমনই দাঁড়িয়েছে। তবে শোন, তুমি যদি আমাকে হত্যা কর, তাহলে আমার খুনের প্রতিশোধ নেয়া হবে। কারণ আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই। আর যদি আমাকে ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি এমন একজন ব্যক্তিকে ক্ষমা করবে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তার বদলা দেবার মত যোগ্যতা রাখে। হ্যাঁ, ধন-সম্পদের প্রয়োজন হলে বলো, যত চাও তত দেয়া যেতে পারে।
.
সম্মানিত পাঠক! একটু থামুন এখানে। তার কথা ও বলার ভঙ্গিমার উপর চিন্তা করুন। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সে কত বেআদবি এবং কী পরিমাণ অহংকারের সুরে কথা বলছে! দুনিয়ার অন্য কোনো শাসক হলে তাৎক্ষণিভাবেই ওই বেআদবের শিরোচ্ছেদ করার আদেশ জারি করত। কিন্তু মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সা.এর সহিঞ্চুতা, ধৈর্য, স্থিতিশীলতা, উদার মানসিকতা ও উন্নত চরিত্র দেখুন। তার রুক্ষ ও অশিষ্ট কথাবার্তা শোনার পরও আল্লাহর রাসূল সা. তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দিলেন। কোনো কঠোর কথা বললেন না। বরং সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন,
-তোমরা তার মেহেমানদারি করো।
.
দ্বিতীয় দিন আবারো আল্লাহর রাসূল সা. ছুমামার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কি অবস্থা ছুমামা?”
সে পুনরায় বলল,
-হে মুহাম্মদ! ভালো আছি।
(إن تقتلني تقتل ذا دم)
“আমাকে যদি হত্যা কর তাহলে এমন লোককে হত্যা করা হবে যার খুন বৃথা যাবে না।”
(وإن تعف تعف عن شاكر وإن تسأل مالا تعطه)
“যদি ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি একজন কৃতজ্ঞ লোককে ক্ষমা করবে। আর যদি ধন চাও তাহলে বলো, প্রদান করা হবে।”
.
আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমাদের মত নিঃস্ব-মিসকিনরা হলে বলতাম, তাকে হত্যা করে কি লাভ হবে? ধনী লোক। তার কাছ থেকে ধন-সম্পদই নেয়া উচিৎ। অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও রুজি-রুটির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
.
তৃতীয় দিন। আজ এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হবার কথা। আল্লাহর রাসূল সা. আবার জিজ্ঞাসা করেন,
-“কেমন আছ, ছুমামা ?”
সেও আগের মত বলল,
-ভালো। একইসাথে তার পূর্বের শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করল। তখন বড়ই একগুয়েমির সাথে অহংকারী ভঙ্গিমায় তার গোত্রের উল্লেখ করে। স্বীয় ধন-সম্পদের আধিক্যের কথা বলে। সাথে সাথে ধমকিও উচ্চারণ করল।
.
সাহাবিরা অপেক্ষা করছিলেন, দেখি, এ বেআদবের কি শাস্তি হয়। তারা রাসূলুল্লাহ সা.এর মুখ ও নির্দেশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অপলক নয়নে। রাহমাতুল লিল আলামিন নবী কারিম সা. নির্দেশ দিলেন,
-“তার রশি খুলে দাও।”
অত:পর ছুমামাকে বললেন,
“যাও, বিনা শর্তে তোমাকে মুক্ত করে দিলাম।”
রাসূলুল্লাহ সা.এর নির্দেশ পালিত হল। ছুমামাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সবাই নির্বাক। নিশ্চুপ। একে অপরের মুখ দেখাদেখি করছে উপস্থিত সবাই।
.
ছুমামা তার সওয়ারি নেয় এবং মদিনা থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা.এর দয়া ও করুণায় সে তো তার জানটা বাঁিচয়ে বের হয়ে এসেছিল কিন্তু তার হৃদয় রেখে এসেছিল রহমতের নবী ও রাসূলের উন্নত চরিত্রের কব্জায়।
.
মসজিদে নববি থেকে বের হয়ে যাবার সময় হঠাৎ তার মনে হল, এত সহিঞ্চু! এত উচুঁ মাপের সাহসী মানুষ তো আজ পর্যন্ত দেখিনি আমি। আমার শব্দগুলোতে কত কঠোরতা ও রূঢ়তা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর সহনশীলতা তাঁর রাগের উপর জয়ী হল। তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন... জনৈক উর্দু কবি সেই অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
আমাকে নিজের আপন করে সে ছেড়ে দিল
আহা, কী বন্দিত্ব ছিল, কী দারুন মুক্তি ছিল!
সীরাত সাহিত্যিকগণ লিখেছেন, মদিনার একটি বাগানে যায় ছুমামা। কূপের পানি দিয়ে গোসল করে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে। অত:পর তার পা সয়ংক্রিয়ভাবে মসজিদে নববির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
আল্লাহর রাসূল সা. তখনো মসজিদে নববিতেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাকে দেখে বললেন,
- “আরে ছুমামা! আমরা তো তোমাকে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। তুমি ফের চলে এলে যে?”
সে আরজ করল,
-আপনার মুক্তিও কি চমৎকার মুক্তি! আপনি তো আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন ঠিকই, তবে আজীবনের জন্য আপন বানিয়ে ছেড়ে দিলেন। এখন আমি বাদশাহ নই; আপনার গোলাম। আমার প্রত্যাশা, আপনি আমাকে কালিমা পড়ান এবং আপনার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের দলে শামিল করে নিন।
.
ইসলামের নেয়ামত লাভের পর ছুমামা বলল,
-হে আল্লাহর রাসূল সা.! এই পৃথিবীতে আপনার চেহারা আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য ছিল। আপনার ধর্মকে ভীষণ অপসন্দ করতাম আমি। আপনার শহর আমার জন্য সবচাইতে বেশি অপসন্দের ছিল। কিন্তু এখন আপনার রহমতের ছায়া তলে আসার পর আপনার চেহারা পৃথিবীর সব চেহারার চাইতে বেশি প্রিয় হয়ে গেল। দুনিয়ার কোনো ধর্ম আপনার ধর্মের চাইতে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ নয়। আপনার এ এলাকা পৃথিবীর সকল এলাকার তুলনায় আমার চোখে প্রিয়তম।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর বান্দা ও রাসূল।
.
ছুমামা রা. আরজ করেন,
-হে আল্লাহর রাসূল! উমরার নিয়তে আমি ঘর থেকে বের হয়ে ছিলাম। এখন আমি যেহেতু মুসলমান হয়ে গেছি, আমাকে উমরার অনুমতি দিন।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষা দিলেন তাকে রাসূল সা.। উমরার সঠিক পদ্ধতি বাতলে দিলেন। তারপর ছুমামা মক্কা রওয়ানা হয়ে যান।
.
ছুমামা রা. ছিলেন আরবের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর বৈশিষ্ট্য এবং ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করেন। কাফিরদের জন্য এসব আলাপ বড়ই কষ্টদায়ক ছিল। তাই তারা বলল, “ছুমামা বেদ্বীন হয়ে গেছে।” তিনি বললেন,
-আল্লাহর কসম! আমি বেদ্বীন হইনি; বরং আমি মুসলমান হয়েছি। আমি মুহাম্মদ সা.এর নুবয়তকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি।
সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে ছুমামার জান ! ইয়ামামা থেকে গমের একটি দানাও এখন মুহাম্মদ সা.এর অনুমতি ব্যতিরেকে মক্কায় আসবে না।
নিজের এলাকায় পৌঁছে তার কথাকে কার্যকর করেছেন তিনি। মক্কায় ফসল সাপ্লাই বন্ধ করে দিলেন। ফলে মক্কায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়। মক্কাবাসীরা রাসূলুল্লাহ সা.এর নিকট পত্র লিখল। তাতে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে দরখাস্ত করেছে তারা, তিনি যেন ইয়ামামা থেকে গম সাপ্লাইয়ের জন্য ছুমামার প্রতি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করেন।
.
সুপ্রিয় পাঠক! এখানে কিছুক্ষণের জন্য থেমে যান। চিন্তা করুন, আল্লাহর রাসূল সা. কী পরিমাণ উদার ছিলেন? কী মহৎ এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন! মক্কাবাসীদের নির্মম জুলুম ও অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি ছুমামা রা.এর নিকট পয়গাম পাঠালেন, তিনি যেন মক্কাবাসীদের জন্য গমের সাপ্লাই অব্যাহত রাখেন। এমন বিরল ও মহান চরিত্রের দ্বিতীয় কোনো নজির দুনিয়ায় আছে কি?
৩৪৩
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
তিনি কি অাপনাকে নিরাশ্রয় ইয়াতীম পাননি অার অাশ্রয় দেননি? তিনি......
ইমানদারগণ জান্নাতের অধিকারী নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ অতঃপর......
অাল্লাহকে ভয় করুন বান্দা যখন গোপনে আল্লাহকে ভয় করে.. ইবাদত......
মহান অাল্লাহ তাকিয়ে থাকেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- আল্লাহ্ তার বান্দার......
অামাদের অাদর্শ প্রিয় নবী সা: হযরত রাসুলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন......
যে দোয়াই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয় হজরত নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ......
ক্ষমা করতে শিখুন হিজরি দ্বিতীয় সালের ঘটনা। মাহে রমজান। বদরের......
ইমানদারদের জন্য জাহান্নাম হারাম হযরত রাসূল সাঃ বলেন : যে......
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি......
তিনটা বিষয়ে কখনো আপোষ করা যায় না ১. স্বাস্থ্য। ২.......