সংবাদ :
জাতীয় : জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত- বাংলাদেশের আকাশে আজ পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে, ১০ জুলাই রবিবার সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে ইসলামিক বিশ্ব : আরাফাতে খুতবা দিবেন শায়খ ড. মুহাম্মাদ আবদুল করীম , হজের খুতবা সরাসরি সম্প্রচার হবে বাংলাসহ ১৪ ভাষায় আন্তর্জাতিক : আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৩য় স্থান অর্জনকারী সালেহ আহমদ তাকরিমকে সংবর্ধনা প্রদান করল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন

  • টেক্সট সাইজ
  • A
  • A
  • A
  • |
  • রং
  • C
  • A
  • A
  • A

জিহাদের উদ্দেশ্য
প্রিন্ট
প্রকাশঃ : শনিবার ০৮/০৭/২০১৭

নমায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ৷ সেই আলোচনা প্রসঙ্গে বার বার আমি বলেছি যে, এসব ইবাদত অন্যান্য ধর্মের ইবাদতের ন্যায় নিছক পূজা, উপাসনা এবং যাত্রার অনুষ্ঠান মাত্র নয়; কাজেই এ কয়টি কাজ করে ক্ষান্ত হলেই আল্লাহ তা'আলা কারো প্রতি খুশি হতে পারেন না ৷ মূলতঃ একটি বিরাট উদ্দেশ্যে মুসলমানদেরকে প্রস্তুত করার জন্য এবং একটি বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজে তাদেরকে সুদক্ষ করার উদ্দেশ্যেই এসব ইবাদত মুসলমানদের প্রতি ফরয করা হয়েছে৷ এটা মুসলমানকে কিভাবে সেই বিরাট উদ্দেশ্যর জন্য প্রস্তুত করে এবং এর ভিতর দিয়ে মুসলমান কেমন করে সেই বিরট কাজের ক্ষমতা ও যোগ্যতা লাভ করে, ইতিপূর্বে তা আমি বিস্তারিত রূপে বলেছি ৷ এখন সেই বিরাট উদ্দেশ্যের বিশ্লেষণ এবং তার বিস্তারিত পরিচয় দানের চেষ্টা করবো ৷

এ বিষয়ে সংক্ষেপে বলা যায় যে, মানুষের উপর থেকে গায়রুল্লাহর (আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য শক্তির) প্রভুত্ব বিদূরিত করে শুধু আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করাই এসব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য এবং এ উদ্দেশ্য লাভের জন্য মন-প্রাণ উৎসর্গ করে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করার নামই হচ্ছে জিহাদ ৷ নামায, রোযা ও যাকাত প্রভৃতি ইবাদাতের কাজগুলো মুসলমানকে এ কাজের জন্য সর্বতোভাবে প্রস্তুত করে৷ কিন্তু মুসলমানগণ যুগ যুগ ধরে এ মহান উদ্দেশ্য ও বিরাট কাজকে ভুলে আছে৷ তাদের সমস্ত ইবাদাত বন্দেগী নিছক অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ৷ তাই আমি মনে করি যে, জিহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, এর অন্তর্নিহিত বিরাট লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত হওয়ার জন্য কিছুমাত্র যথেষ্ট নয় ৷ সে জন্য বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আবশ্যক ৷

দুনিয়ায় যত পাপ, অশান্তি আর দুঃখ-দুর্দশা স্থায়ী হয়ে রয়েছে, তার মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র এবং শাসন ব্যবস্থার মূলগত দোষ-ত্রুটি, শক্তি এবং সম্পদ সবই সরকারের করায়ত্ব থাকে ৷ সরকারই আইন রচনা করে এবং জারী করে ৷ দেশের নিয়ম-শৃংখলা রক্ষা, শাসন ইত্যাদির যাবতীয় ক্ষমতা সরকারেরই একচ্ছত্র অধিকারের বস্তু। পুলিশ ও সৈন্য-সামন্তের শক্তি সরকারের কুক্ষিগত হয়ে থাকে ৷ অতএব, এতে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে, যা কিছু অশান্তি এবং পাপ দুনিয়ায় আছে তা হয় সরকার নিজেই সৃষ্টি করে, নতুবা সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাহায্য ও সমর্থনে তা অবাধে অনুষ্ঠিত হতে পারছে ৷ কারণ দেশের কোন জিনিসের প্রচার ও স্থায়িত্ব লাভের জন্য যে শক্তির আবশ্যক তা সরকার ছাড়া আর কারো থাকতে পারে না ৷ চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়, দুনিয়ার চার দিকে ব্যভিচার অবাধে অনুষ্ঠিত হচ্ছে---- দালান কোঠায়, বাড়ীতে প্রকাশ্যভাবে এ পাপকার্য সম্পন্ন হচ্ছে৷ কিন্তু এর কারণ কি? এর একমাত্র কারণ এই যে, রাষ্ট্র ও সরকার কতৃর্পক্ষের দৃষ্টিতে ব্যভিচার বিশেষ কোন অপরাধ নয়৷ বরং তারা নিজেরাই এ কাজে লিপ্ত হয়ে আছে এবং অন্যকেও সে দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ৷ নুতবা সরকার যদি এ পাপানুষ্ঠান বন্ধ করতে চায়, তবে এটা এত নির্ভিক ভাবে চলতে পারে না ৷ অন্যদিক সুদের কারবার অব্যাহতভাবে চলছে ৷ ধনী লোকগণ গরীবদের বুকের তাজা-তপ্ত রক্ত শুষে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে ৷ কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এটা কেমন করে হতে পারছে? শুধু এই যে সরকার নিজেই সুদ খায় এবং সুদখোরদের সাহায্য ও সমর্থন করে৷ সরকারের আদালতসমূহ সুদের ডিক্রী দেয় এবং তাদের সহায়তা পায় বলে চারদিকে বড় বড় ব্যাংক আর সুদখোর মহাজন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ বর্তমান সময়ে দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে ও সমাজে লজ্জাহীনতা ও চরিত্রহীনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ এরও একমাত্র কারণ এই যে, সরকার নিজেই লোকদেরকে এরূপ শিক্ষা দিচ্ছে এবং তাদের চরিত্রকে এরূপেই গঠন করছে৷ চারিদিকে মানব চরিত্রের যে নমুনা দেখা যাচ্ছে, সরকার তাই ভালবাসে ও পছন্দ করে ৷ এমতাবস্থায় জনগণের মধ্যে যদি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের কোন শিক্ষা ও নৈতিক চরিত্র গঠনের চেষ্টা করতে চায় তাতে সফলতা লাভ করা সম্ভব হতে পারে না৷ কারণ, সে জন্য যে উপায়-উপাদান একান্ত অপরিহার্য তা সংগ্রহ করা বেসরকারী লোকদের পক্ষে সাধারণতঃ সম্ভব হয় না৷ আর বিশেষ প্রচেষ্টার পর তেমন কিছু লোক তৈরী করতে পারলেও প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের নিজ নিজ আদর্শের উপর সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে৷ যেহেতু জীবিকা উপার্জেনের যত উপায় আছে এবং এই ভিন্নতর চরিত্র-বিশিষ্ট্য লোকদের বেঁচে থাকার যত গুলো পন্থা থাকতে পারে, তার সবগুলোই বন্ধ দরজার চাবিকাঠি সাম্প্রতিক বিকৃত ও গোমরাহ্ সরকারের হাতেই নিবদ্ধ রয়েছে৷ দুনিয়ায় সীমা-সংখ্যাহীন খুন-যখম ও রক্তপাত হচ্ছে৷ মানুষের বুদ্ধি এবং জ্ঞান আজ গোটা মানুষকে ধ্বংস করার উপায় উদ্ভাবনেই নিযুক্ত হয়ে আছে৷ মানুষের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমলব্ধ প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আজ আগুনে জ্বালিয়ে ভষ্ম করা হচ্ছে৷ মানুষের অসংখ্য মূল্যবান জীবনকে মূল্যহীন মাটির পাত্রের ন্যায় অমানুষিকভাবে সংহার করা হচ্ছে৷ কিন্তু এটা কেন হয়? হওয়ার কারণ শুধু এটাই যে, মানব সন্তানের মধ্যে যারাই সর্বপেক্ষা বেশী শয়তান প্রকৃতির ও চরিত্রহীন, তারাই আজ দুনিয়ার জাতিসমূহের 'নেতা' হয়ে বসেছে এবং কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের সার্বভৌম শক্তি নিজেদরাই কুক্ষিগত করে নিয়েছে ৷ আজ শক্তি সামগ্রিকভাবে তাদের করতলগত, তাই তারা আজ দুনিয়াকে যে দিকে চালাচ্ছে দুনিয়া সে দিকেই চলতে বাধ্য হচ্ছে ৷ জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধন-সম্পদ, শ্রম মেহনত এবং জীবন ও প্রাণের ব্যবহার এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা যা কিছু নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তাতেই আজ সব উৎ‌সর্গীকৃত হচ্ছে ৷ দুনিয়ায় আজ যুলুম ও অবিচারের প্রবল রাজত্ব চলছে ৷ দুর্বলের জীবন বড়ই দুঃসহ হয়ে পড়েছে ৷ এখানকার আদালত বিচারালয় নয় এটা আজ বানিয়ার দোকান বিশেষে পরিণত হয়েছে ৷ এখানে আজ কেবল টাকা দিয়ে 'বিচার' ক্রয় করা যায়৷ মানুষের মাঝ থেকে আজ জোর-যবরদস্তি করে ট্যাক্স আদায় করা হয়৷ সেই ট্যাক্সের পরিমাণেও কোন সীমাসংখ্যা নেই এবং সরকার তা উচ্চ কর্মচারীদেরকে রাজকীয় বেতন ও ভাতা দেয়ায় (উজির-দূতের টি-পার্টি আর ককটেল পার্টি দেয়ায়), বড় বড় দালান-কোঠা তৈরী করায়, লড়াই সংগ্রামের জন্য গোলা বারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করায় এবং এ ধরনের অসংখ্য অর্থহীন কাজে গরীবদের রক্ত পানি করে উপর্জিত অর্থ-সম্পদ নির্বিচারে খরচ করছে৷ সুদখোর-মহাজন, জমিদার, রাজা এবং সরদার উপাধি প্রাপ্ত এবং উপাধি প্রার্থীর রাজন্যবর্গ, গদিনশীন পীর ও পুরোহিত, সিনেমা কোম্পানীর মালিক, মদ ব্যবসায়ী, অশ্লীল পুস্তক-পত্রিকা প্রকাশক ও বিক্রেতা এবং জুয়াড়ী প্রভৃতি অসংখ্য লোক আজ আল্লাহর সৃষ্ট অসহায় মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু, চরিত্র ও নৈতিকতা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলছে ৷ কিন্তু তাদেরকে বাধা দেবার কেউ নেই কেন? এজন্য যে, রাষ্ট্রযন্ত্র বিপর্যস্ত হয়েছে, শক্তিমান লোকেরা নিজেরাই ভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তারা নিজেরা তো যুলুম করেই, পরন্তু অন্যান্য যালেমকেও সাহায্য করে ৷ মোটকথা দেশে দেশে যে যুলুমই অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার একমাত্র কারণ এই যে, সাম্প্রতিক সরকার এরই পক্ষপাতী এবং নিরবে সহ্য করে ৷

এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে আশা করি একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সমস্ত বিপর্যয়ের মূল উৎ‌স হচ্ছে হুকুমতের খারাবী ৷ মানুষের মত ও চিন্তার খারাপ হওয়া, আকীদা বিকৃত হওয়া, মানবীয় শক্তি, প্রতিভা ও যোগ্যতার ভ্রান্ত পথে অপচয় হওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যেও মারাত্মক নীতি-প্রথার প্রচলন হওয়া, যুলুম, না-ইনসাফী ও কুৎসিত কাজ-কর্মের প্রসার লাভ হওয়া এবং বিশ্বমানবের ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রভৃতি সবকিছুরই মূল কারণ একটি এবং তা এই যে, সমাজ ও সরকারের নেতৃত্ব, শক্তি সবই আজ অনাচারী ও দুরাচারী লোকদের হাতে চলে গেছে। আর শক্তি ও সম্পদের চাবিকাঠি যদি খারাপ লোকদের হাতে থাকে এবং জীবিকা নির্বাহের সমস্ত উপায়ও যদি তাদেরই করায়ত্ব হয়ে থাকে তবে শুধু যে তারাই আরও খারাপ হয়ে যাবে তাই নয় বরং সমগ্র দুনিয়াকে আরও অধিক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে, তাদের সাহায্য ও সমর্থনের সর্বব্যাপী বিপর্যয় আরও মারাত্মকভাবে জেগে উঠবে ৷ বস্তুতঃ তাদের হাতে শক্তি থাকা পর্যন্ত আংশিক সংশোধনের জন্য হাজার চেষ্টা করলেও তা সফল হতে পারে না, একথা একেবারে সুস্পষ্ট ৷

এ বুনিয়াদী কথাটি বুঝে নেয়ার পর মূল বিষয়টি অতি সহজেই বোধগম্য হতে পারে৷ মানুষের দূরবস্থা দূর করে এবং আসন্ন ধ্বংস থেকে তাদেরকে রক্ষা করে এক মহান কল্যাণকর পথে পরিচালিত করার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সরকারের কর্মনীতিকে সুসংবদ্ধ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ হতে পারে না ৷ একজন সাধারণ বু‌দ্ধির মানুষও একথা বুঝতে পারে যে, যে দেশের লোকদের ব্যভিচার করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে সেখানে ব্যভিচারের বিরুদ্ধে হাজার ওয়াজ করলেও তা কিছুতেই বন্ধ হতে পারে না ৷ কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি দখল করে যদি ব্যভিচার বন্ধ করার জন্য বল প্রয়োগ করা হয়, তবে জনসাধারণ নিজেরাই হারাম পথ পরিত্যাগ করে হালাল উপায় অবলম্বন করতে বাধ্য হবে ৷ মদ, গাঁজা, সুদ, ঘুষ, অশ্লীল সিনেমা-বায়স্কোপ, অর্ধনগ্ন পোষাক, নৈতিকতা বিরোধী শিক্ষা এবং এ ধরনের যাবতীয় পাপ প্রচলনকে নিছক ওয়াজ-নসিহত দ্বারা বন্ধ করতে চাইলে তা কখনও সম্ভব হবে না ৷ অবশ্য রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করে চাইলে তা কখনো সম্ভব হবে না। যারা জনসাধারণকে শোষণ করে এবং তাদের চরিত্র নষ্ট করে, তাদেরকে শুধু মৌখিক কথা দ্বারা লাভজনক কারবার থেকে বিরত রাখা যাবে না ৷ কিন্তু শক্তি লাভ করে যদি অন্যায় আচরণ বন্ধ করতে চেষ্টা করা হয় তবে অতি সহজেই সমস্ত পাপের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে ৷ মানুষের শ্রম, মেহনত, সম্পদ, প্রতিভা ও যোগ্যতার এই অপচয় যদি বন্ধ করতে হয় এবং সেগুলোকে সঠিক ও সুস্থ পথে প্রয়োগ করতে হয়, যুলুম বন্ধ করে যদি বিচার-ইনসাফ কায়েম করতে হয়, দুনিয়াকে ধ্বংস এবং ভাঙ্গনের করাল গ্রাস ও সর্বপ্রকার শোষণ থেকে রক্ষা করে মানুষকে যদি বাঁচাতে হয়, অধঃপতিত মানুষকে উন্নত করে সমস্ত মানুষকে যদি সমান মান-সম্মান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে শুধু মৌখিক ওয়াজ নসীহত দ্বারা এ কাজ কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না ৷ অবশ্য এ জন্য যদি রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করা হয়, তবে তা খুবই সহজে সম্পন্ন হতে পারে ৷ অতএব এতে আর কোন সন্দেহ নেই যে, সমাজ সংস্কারের কোন প্রচেষ্টাই রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ ছাড়া সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না ৷ একথা আজ এতই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এটা বুঝার জন্য খুব বেশী চিন্তা-গবেষণার আবশ্যক হয় না ৷ আজ দুনিয়ার বুক থেকে প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি ফেতনা-ফাসাদ দূর করতে চাইবে এবং দুনিয়ার মানুষের দুরাবস্থা দূর করে শান্তি এবং সমৃদ্ধি স্থাপন করতে অন্তর দিয়ে কামনা করবে তার পক্ষে আজ শুধু ওয়ায়েজ ও উপদেশদাতা হওয়া একেবারেই অর্থহীন ৷ আজ তাকে উঠতে হবে এবং ভ্রান্ত নীতিতে স্থাপিত সরকার ব্যবস্থাকে খতম করে দিয়ে, ভ্রান্ত নীতি অনুসারী লোকদের হাত থেকে রাষ্ট্রশক্তি কেড়ে নিয়ে সঠিক নীতি এবং খাঁটি (ইসলামী) নীতির রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করতে হবে ৷

এ তত্ত্ব বুঝে নেয়ার পর আর এক কদম সামনে অগ্রসর হোন৷ একথা ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে যে, দুনিয়ার মানুষের জীবনে যত কিছু খারাবী ও অশান্তি প্রসারিত হচ্ছে, তার মূলীভূত কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের ভ্রান্তি৷ এবং একথাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সংশোধন যদি করতে হয়, তবে এর মূল শিকড়ের সংশোধন করতে হবে সর্বাগ্রে ৷ কিন্তু প্রশ্ন এই যে, স্বয়ং রাষ্ট্র ও সরকারের দোষ-ত্রুটির মূল কারণ কি এবং কোন্‌ মৌলিক সংশোধনের দ্বারা সেই বিপর্যয়ের দুয়ার চিরতরে বন্ধ করা যেতে পারে?

এর একমাত্র জবাব এই যে, আসলে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বই হচ্ছে সকল বিপর্যয়ের মূল কারণ ৷ অতএব সংশোধনের একমাত্র উপায় স্বরূপ মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব খতম করে দিয়ে আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করতে হবে৷ এতবড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব শুনে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বস্তুতঃ এই প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে যতই খোঁজ ও অনুসন্ধান করা হবে, এই একটি মাত্র কথাই এর সঠিক জবাব হতে পারে বলে বিবেচিত হবে৷

একটু চিন্তা করে দেখুন, যে দুনিয়ায় মানুষ বাস করে তা আল্লাহ তা'আলা সৃষ্টি করেছেন, না অন্য কেউ? পৃথিবীর এই মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, না অন্য কেউ? মানুষের জীবন যাত্রা নির্বাহের এ সীমাসংখ্যাহীন উপায়-উপাদান আল্লাহ্ সংগ্রহ করে দেন, না অন্য কোন শক্তি? এ প্রশ্নগুলোর একটি মাত্র উত্তরই হতে পারে এবং এছাড়া অন্য কোন উত্তর বস্তুতঃই হতে পারে না যে, পৃথিবীর মানুষ এবং এ সমস্ত দ্রব্য-সামগ্রী একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই সৃষ্টি করেছেন৷ অন্যকথায় এ পৃথিবী আল্লাহর, ধন-সম্পদের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ, মানুষ একমাত্র আল্লাহরই প্রজা ৷ এমতাবস্থায় আল্লাহর রাজ্যে অপরের হুকুম চালাবার কি অধিকার থাকতে পারে? আল্লাহর 'প্রজা' সাধারণের উপর আল্লাহ ছাড়া অন্যের রচিত আইন কিংবা স্বয়ং প্রজাদের রচিত আইন কি করে চলতে পারে? দেশ ও রাজ্য হবে একজনের আর সেখানে আইন চলবে অপরের ৷ মালিকানা হবে একজনের আর মালিক হয়ে বসবে অন্য কেউ? প্রজা হবে একজনের আর তার উপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য কারো? মানুষের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি একথা কেমন করে স্বীকার করতে পারে? বিশেষত এ কথাটাই প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ৷ আর যেহেতু এটা প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ খেলাপ, তাই যখনই এবং যেখানেই এরূপ হয়েছে সেখানে তারই পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক হয়েছে ৷ যেসব মানুষ আইন প্রণয়ন ও প্রভুত্ব করার অধিকার লাভ করে তারা নিজেরা স্বাভাবিক মূর্খতা ও অক্ষমতার দরুনই নানারূপ বিরাট বিরাট ভুল করতে বাধ্য হয় ৷ আবার অনেকটা নিজেদের পাশবিক লালসার বশঃবর্তী হয়ে ইচ্ছা করে যুলুম ও অবিচার করতে শুরু করে ৷ তার প্রথম কারণ এই যে, মানবীয় সমস্যা ও ব্যাপার সমূহের সুষ্ঠু সমাধান ও পরিচালনার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় নিভুর্ল নিয়ম-কানুন রচনা করার মত জ্ঞান-বুদ্ধি এবং বিদ্যাই তাদের থাকে না ৷ দ্বিতীয়তঃ তাদের মনে আল্লাহর ভয় এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার আতঙ্ক আদৌ থাকে না বলেই তারা একেবারে বল্গাহারা পশু হয়ে যায় এবং এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী মারাত্মক ৷ যে মানুষের মনে আল্লাহর ভয় একবিন্দু থাকবে না এবং কোন উচ্চতর শক্তির কাছে জবাবদিহি করার চিন্তাও যার হবে না; বরং যার মন এই ভেবে নিশ্চিন্ত হবে যে, 'আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারে এমন কোন শক্তি কোথাও নেই' -এ ধরনের মানুষ যখন শক্তি লাভ করবে, তখন তারা যে বল্গাহারা হিংস্র পশুতে পরিণত হবে তাতে আর সন্দেহ কি? একথা বুঝার জন্য খুব বেশী বুদ্ধি-জ্ঞানের আবশ্যক করে না ৷ এসব লোকের হাতে যখন মানুষের জীবন-প্রাণ এবং রিযিক ও জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় জিনিসের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব এসে পড়বে, যখন কোটি কোটি মানুষের মস্তক তাদের সামনে অবনমিত হবে, তখন তারা সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের আদর্শ রক্ষা করে চলবে এমন আশা কি কিছুতেই করা যায়? তারা পরের হক কেড়ে নিতে, হারাম উপায়ে ধন লুন্ঠন করতে এবং আল্লাহর বান্দাহগণকে নিজেদের পশু বৃত্তির দাসানুদাস বানাতে চেষ্টা করবে না, এ ভরসা কিছুতেই করা যেতে পারে না ৷ এমন ব্যক্তি নিজেরা সৎপথে থাকবে এবং অন্য মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে, এমন কোন যুক্তি আছে কি? কখনও নয় ৷ মূলতঃই তা সম্ভব হতে পারে না, হওয়া বিবেক-বুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী৷ হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে৷ বর্তমান সময়েও যাদের মনে অল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাবদিহির আতঙ্ক নেই, তারা শক্তি ও ক্ষমতা লাভ করে কত যুলুম, বিশ্বাসঘাতকতা ও মানবতার চরম শত্রুতা করতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ চোখ খুললেই দেখতে পাওয়া যায় ৷

কাজেই আজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসন পদ্ধতির গোড়াতেই সর্বাত্মক আঘাত হানতে হবে৷ অর্থাৎ, মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব ক্ষমতাকে নিমূর্ল করে তথায় একমাত্র আল্লাহ তা'আলার প্রভুত্ব ও আইন প্রণয়নের অধিকার স্থাপিত করতে হবে ৷

অতপর যারাই আল্লাহর প্রভুত্বের বুনিয়াদে হুকুমাত কায়েম করবে ও চালাবে তারা নিজেরা কখনই রাজাধিরাজ ও একচ্ছত্র প্রভু হয়ে বসতে পারবে না- আল্লাহকেই একমাত্র বাদশাহ স্বীকার করে তাঁর প্রতিনিধি হয়েই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করতে হবে ৷ এ দায়িত্ব হলো তাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে অর্পিত মহান আমানত ৷ একথা তদের অবশ্যই মনে করতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত একদিন না একদিন তাদের এ আমানতের হিসেব দিতে হবে সেই মহান আল্লাহর সমীপে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য- সবকিছুই জানেন ৷ রাষ্ট্রের বুনিয়াদী আইন হবে আল্লাহর দেয়া বিধান ৷ কারণ তিনি সবকিছুরই নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত- সকল জ্ঞানের উৎস একমাত্র তিনিই ৷ তাই তাঁর আইন ও বিধানের এক বিন্দু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার ক্ষমতা বা অধিকার কারো থাকবে না ৷ তাহলেই তারা মানুষের মূর্খতা, স্বার্থপরতা এবং অবাঞ্ছিত পাশবিক লালসার অনধিকার চর্চা থেকে চিরকাল সুরক্ষিত থাকতে পারবে ৷ ইসলাম এ মূল সংশোধনের দায়িত্ব নিয়েই দুনিয়ায় এসেছে ৷ সমগ্র বিপর্যায়ের মূল উৎসকেই এটা এমনিভাবে সংশোধন করতে চায়৷ আল্লাহকে যারা নিজেদের বাদশাহ-কেবল মৌখিক আর কাল্পনিক বাদশাই নয়-প্রকৃত বাদশাহ বলে স্বীকার করবে এবং তিনি তাঁর নবীর মধ্যস্থতায় যে বিধান দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তাকে যারা বিশ্বাস করবে ইসলাম তাদের কাছে এ দাবী উত্থাপন করে যে, তারা যেন তাদের বাদশাহর রাজ্যে তার আইন ও বিধান জারি করার জন্য সচেষ্ট হয় ৷ সেই বাদশাহর যে সব প্রজা বিদ্রোহী হয়েছে এবং নিজেরাই রাজাধিরাজ হয়ে বসেছে তাদের শক্তি ক্ষুন্ন করতে হবে, আর আল্লাহর প্রজাবৃন্দকে অন্য শক্তির 'প্রজা' হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে ৷ আল্লাহকে 'আল্লাহ' এবং তাঁর আইনকে জীবন বিধান বলে কেবল স্বীকার করাই ইসলামের দৃষ্টিতে কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়; বরং সেই সাথে এ কর্তব্যও আপনা আপনিই তাদের উপর আবর্তিত হয় যে, তোমরা যেখানেই বাস কর, যে দেশ বা রাজ্যেই তোমাদের বাসস্থান হোক না কেন সেখানেই মানুষের সংশোধন প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে ৷ সেখানকার ভ্রান্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলিয়ে সঠিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ আল্লাহদ্রোহী নাস্তিক ও আল্লাহ্ নির্দিষ্ট সীমালংঘনকারী লোকদের হাত থেকে আইন রচনা ও দায়িত্ব নিজেদের হাতে গ্রহণ করে আল্লাহর বিধান অনুসারে পরকালে জবাবদিহির জাগ্রত অনুভূতি সহকারে আল্লাহকে 'আলেমুল গায়েব' মনে করেই রাষ্ট্রীয় কার্যসম্পন্ন কর ৷ বস্তুতঃ এই উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করার নামই জিহাদ ৷

প্রভুত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার মূলতঃই অত্যন্ত জটিল, দায়িত্বপূর্ণ কাজ সন্দেহ নেই ৷ তা লাভ করার বাসনা কারো মনে জাগ্রত হলেই তার মধ্যে স্বভাবতই লালসার লেলিহান শিখা জ্বলে উঠে ৷ পৃথিবীর ধন-সম্পদ ও মানুষের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার লাভ হলেই মানুষের মধ্যে সুপ্ত লালসা জেগে উঠে, তখন মানুষের উপর নিরংকুশ প্রভুত্ব বিস্তারের স্পৃহা সৃষ্টি হয় ৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করা খুব কঠিন কাজ নয়; কিন্তু তা লাভ করার পর নিজে আল্লাহ্ না হয়ে 'আল্লাহর অনুগত দাস' হিসেবে কর্তব্য পালন করা অধিকতর কঠিন ব্যাপার ৷ কাজেই এক ফির'আউনকে পদচ্যুত করে তুমি নিজে যদি সেখানে 'ফির'আউন' হয়ে বস, তাহলে আসলে লাভ কিছুই হলো না ৷ কাজেই এ বিরাট অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে ইসলাম তোমাকে সে জন্য সর্বতোভাবে তৈরী করে দেয়া অপরিহার্য মনে করে৷ স্বয়ং তোমার মন ও মগয থেকে স্বার্থপরতা ও আত্মম্ভরিতা দূর না হলে, তোমার মন ও আত্মা নির্মল না হলে, নিজের বা জাতীয় স্বার্থের খাতিরে লড়াই করার পরিবর্তে খালেস ভাবে আল্লাহর সন্তোষ লাভ ও বিশ্ব মানবের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সাধনা ও সংগ্রাম করতে প্রস্তুত না হলে; উপরন্তু রাষ্ট্রশক্তি লাভ করার পর নিজের লোভ-লালসা ও দুষ্প্রবৃত্তির অনুসরণ করে আল্লাহ্ হয়ে বসার পরিবর্তে প্রাণে ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার যোগ্যতা না জন্মালে রাষ্ট্র শক্তি লাভের দাবী উত্থাপন করা এবং দুনিয়ার বাতিল শক্তির সাথে লড়াই শুরু করে দেয়ার কোন অধিকার কারো থাকতে পারে না ৷

কালেমা পড়ে ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করলেই ইসলাম তোমাকে মানুষের উপর আক্রমন করার অধিকার বা অনুমতি দেয় না ৷ কারণ, তখন তুমিও ঠিক সেই দুষ্কার্য করতে শুরু করবে; যা করছে দুনিয়ার বর্তমান আল্লাহদ্রোহী ও যালেম লোকাগণ ৷ বরং এতবড় বিরাট দায়িত্ব গ্রহণ করার আদেশ দেয়ার পূর্বে ইসলাম তোমার মধ্যে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার যোগ্যতা সৃষ্টি করতে চায় ৷

বস্তুতঃ ইসলামে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদাতসমূহ এ উদ্দেশ্যে প্রস্তুতির জন্যই নির্দিষ্ট হয়েছে ৷ দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি নিজ নিজ সৈন্যবাহিনী, পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের সর্বপ্রথম এক বিশেষ ধরনের ট্রেনিং দিয়ে থাকে ৷ সেই ট্রেনিং- এ উপযুক্ত প্রমাণিত হলে পরে তাকে নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত করা হয় ৷ ইসলামও তার কর্মচারীদের সর্বপ্রথম এক বিশেষ পদ্ধতির ট্রেনিং দিতে চায়৷ তারপরই তাদের জিহাদ ও ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার দায়িত্ব দেয়া হয় ৷ তবে এ উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে৷ দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহ তাদের কর্মচারীদের যে কাজে নিযুক্ত করে থাকে তাতে নির্মল নৈতিক চরিত্র, মনের নিষ্কলুষতা ও পবিত্রতা এবং আল্লাহর ভয় সৃস্টির কোনই আবশ্যক হয় না ৷ এ জন্য তাদেরকে কেবল সুদক্ষ করে তোলারই চেষ্টা করা হয় ৷ আর সুদক্ষ হওয়ার পর সে যদি ব্যভিচারী হয়, মদ্যপায়ী হয়, বেঈমান ও স্বার্থপর হয় তবুও তাতে কোনরূপ আপত্তির কারণ নেই৷ কিন্তু ইসলাম তার কর্মীদের উপর যে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে তা আগা গোড়া সবই হচ্ছে একান্তভাবে নৈতিক কাজ৷ অতত্রব ইসলামে তাদের সুদক্ষ করে তোলার দিকে যতখানি লক্ষ্য দেয়া হয়, তাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগিয়ে তোলা এবং তাদের মন ও আত্মাকে পবিত্র করার দিকে গুরুত্ব দেয়া হয় তদপেক্ষা অনেক বেশী ৷ ইসলাম তাদের মধ্যে এতখানি শক্তি জাগাতে চায় যে, যখন তারা দুনিয়ার বুকে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করার দাবী নিয়ে উঠবে, তখন যেন তারা নিজেদের এ দাবীর ঐকান্তিকতা ও সততা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণ করে দেখাতে পারে৷ তারা যেন কখনই নিজেদের ধন-দৌলত, জমি-জায়গা, দেশ ও রাজ্য, সম্মান ও প্রভুত্ব লাভ করার জন্য লড়াই না করে৷ তারা যেন খাঁটিভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে লড়াই করে, আল্লাহর কোটি কোটি বান্দার জন্য লড়াই করে, আর একথা যেন কাজকর্মের ভেতর দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রমাণিত হয় ৷ তারা বিজয়ী হলে যেন অহংকারী, দাম্ভিক ও আল্লাহদ্রোহী না হয়, তখনও যেন তাদের বিনয়াবনত মস্তক আল্লাহর সামনে অবনমিত থাকে ৷ তারা শাসক হলে মানুষকে যেন তারা নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত না করে৷ বরং নিজেরাই যেন আল্লাহর গোলাম হয়ে জীবন যাপন করে৷ আর আন্যান্য মানুষকেও যেন একমাত্র আল্লাহর দাস বানাতে চেষ্টা করে৷ তারা রাষ্ট্রের ধনভাণ্ডার হস্তগত করে থাকলে তা যেন কেবল নিজের বা নিজের বংশের কিংবা জাতীয় লোকদের পকেট বোঝাই করার কাজে উজাড় করে না দেয়৷ তারা যেন অল্লাহর ধনভাণ্ডারকে তাঁরই বান্দাদের মধ্যে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে বন্টন করে দেয় এবং একজন খাঁটি আমানতদারের ন্যায় একথা স্মরণ রেখে কাজ করে যে, এক অদৃশ্য চোখ তাকে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছে- ওপরে কেউ আছে, যার দৃষ্টি হতে সে কিছুতেই লুকিয়ে থাকতে সক্ষম নয় এবং তারই কাছে তাকে এক এক করে পয়সার হিসাব দিতে হবে৷

বস্তুতঃ মানুষকে এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা ইসলামের নির্দিষ্ট এই ইবাদাতগুলো ছাড়া অন্য কোন উপায়ে সম্ভব হতে পারেনা ৷ আর ইসলাম মানুষকে এভাবে গঠন করে বলেঃ এখন তোমরা দুনিয়ার বুকে আল্লাহর নেক ও সালেহ বান্দাহ, তোমরা সামনে অগ্রসর হও লড়াই সংগ্রাম করে আল্লাহদ্রোহী লোকদেরকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে বিচ্যুত কর এবং সকল ক্ষমতা ও অধিকার নিজেদের হস্তগত করে নাও ৷

সহজেই বুঝতে পারা যায়, যেখানে সৈন্যবাহিনী, পুলিশ, আদালত, জেল ও কর ধার্য্যকরণ ইত্যাদি সকল সরকারী কাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীগণ আল্লাহভীরু হবে, পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার অনিবার্যতা সম্পর্কে সচেতন হবে, যেখানে রাষ্ট্র ও শাসন পরিচালনার সমস্ত নিয়ম-কানুন আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে রচিত হবে, সেখানে অবিচার ও অজ্ঞতার কোন অবকাশ নেই, যেখানে পাপ ও পাপানুষ্ঠানের সমস্ত পথ যথাসময়ে বন্ধ করে দেয়া হয়, সরকার নিজেই শক্তি ও অর্থ ব্যয় করে ন্যায়, পুণ্য ও পবিত্র ভাবধারার বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হয়৷ তথায় মানবতা যে সর্বাঙ্গীন কল্যাণ লাভ করতে পারবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারেনা৷ এ ধরনের সরকার যদি ক্রমাগত চেষ্টা-যত্নের সাহায্যে কিছুকাল পর্যন্ত লোকদের চরিত্র ও স্বভাব প্রকৃতি গঠন করতে নিযুক্ত থাকে, হারাম পন্থায় অর্থলাভ, পাপ, যুলুম, নির্লজ্জতা ও নৈতিক চরিত্রহীনতার সকল উৎস বন্ধ করে দেয়া হয়, ভুল-ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নীতি বন্ধ করে সুস্থ ও নিখুঁত শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা লোকদের মনোভাব ও চিন্তাধারা তৈরী করতে থাকে, তবে তার অধীনে সমাজে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা, শান্তি, নিরাপত্তা, সচ্চরিত্র ও সৎ‌প্রকৃতির পবিত্র পরিবেশে মানুষ জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করবে; তখন মানুষের আমূল পরিবর্তন সূচিত হবে৷ পাপিষ্ঠ ও আল্লাহদ্রোহী নেতৃত্বাধীনে দীর্ঘকাল বসবাস করার ফলে যে চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে তা স্বতঃই সত্যদ্রষ্টা ও সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠবে৷ নৈতিক পঙ্কিলতার মধ্যে পরিবেষ্টিত থাকার দরুন যে অন্তর মসীলিপ্ত ও মলিন হয়ে গেছে; ধীরে ধীরে তা দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছ হয়ে যাবে এবং সত্যের প্রভাব গ্রহণের যোগ্যতা জেগে উঠবে৷ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই যে সকলের একমাত্র রব, তিনি ছাড়া আর কেউ যে বন্দেগী পাওয়ার যোগ্য নয় এবং যে নবীজীর মারফত এ সত্যের পয়গাম লাভ হয়েছে, তিনি যে সত্য ও সত্যবাদী নবী -এ তথ্য গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করা তখনকার পরিবেশে সকলের পক্ষে সহজ হবে৷ আজ যে কথা বুঝিয়ে দেয়া খুবই কঠিন মনে হয়, তখন তাই সকলের মগযে আপনা-আপনি স্থান লাভ করবে৷ আজ বক্তৃতা ও বই-পুস্তকের সাহায্যে যে কথা বুঝানো যায় না, তখনকার দিনে সেই কথা এতদূর সহজবোধ্য হবে যে, তাতে নামমাত্র জটিলতা অনুভূত হবে না ৷

মানুষের মনগড়া মত ও পথ অনুযায়ী কাজ-কর্ম সম্পন্ন হওয়া এবং আল্লাহ নিধার্রিত বিধান অনুযায়ী কার্য সম্পাদনের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে তা যারা প্রত্যক্ষ করতে পারবে, আল্লাহর পরিপূর্ণ একত্ব (তাওহীদ) এবং তার পয়গাম্বরের সত্যতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন তাদের পক্ষে খুবই সহজ এবং তা অবিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে৷ বস্তুত, ফুল ও কাঁটার পার্থক্য জেনে নেয়ার পর ফুল আহরণ করা সহজ এবং কাঁটা সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে থাকে৷ তখনকার দিনে ইসলামের সত্যতা অস্বীকার করা এবং কুফর ও শির্ককে আঁকড়ে থাকা বড়ই কঠিন হবে৷ সম্ভবতঃ খুব বেশী হলেও হাজারে দশজন লোকের মধ্যেই এতখানি গোঁড়ামী পাওয়া যেতে পারে; তার বেশী নয়৷

নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত যে কোন্ বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য ফরয করা হয়েছে, পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আশা করি পাঠকগণ তা সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পেরেছেন৷ যদিও আজ পর্যন্ত এগুলোকে নিছক পূজা অনুষ্ঠানের ন্যায়ই মনে করা হয়েছে এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই ভ্রান্ত ধারণাই বদ্ধমূল করে রাখা হয়েছে৷ এটা যে একটি বিরাট ও উচ্চতর কাজের জন্য প্রস্তুতির উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত প্রচার করা হয়নি৷ এ কারণেই মুসলমানগণ নিতান্ত উদ্দেশ্যহীনভাবেই এ অনুষ্ঠান উদযাপন করে আসছে; কিন্তু মূল কাজের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কোন ধারণাই মনের মধ্যে জাগ্রত হয়নি৷ যদিও মূলতঃ এর জন্যই এ ইবাদাতসমূহ ফরজ হয়েছে; কিন্তু আমি একথা বলতে চাই যে, জিহাদের বাসনা না হলে এবং জিহাদকে উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করলে এ ইবাদাতসমূহ একেবারে অর্থহীন৷ এ ধরনের অর্থহীন অনুষ্ঠান পালন করে যদি আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব মনে করা হয়, তবে বিচারের দিন এর সত্যতা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হবে৷

 

পূর্ববর্তী - পরবর্তী >>

৯৮৬

কোন তথ্যসূত্র নেই

আপনার জন্য প্রস্তাবিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশন

To preach and propagate the values and ideals of Islam, the only complete code of life acceptable to the Almighty Allah, in its right perspective as a religion of humanity, tolerance and universal brotherhood and bring the majority people of Bangladesh under the banner of Islam

অফিসিয়াল ঠিকানা: অফিসিয়াল ঠিকানা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শের-এ- বাংলা নগর, ঢাকা -১২০৭