ঈদুল ফিতর : তাত্পর্য ও বিধান
হিজরি সালের শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখকে ঈদুল ফিতর বলা হয়। রমজানের দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর পহেলা শাওয়াল ঈদের দিন তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে আজকে বান্দার জিয়াফত ও দাওয়াতের দিন। আজকে রোজা রাখা যাবে না; খোদ শরিয়ত কর্তৃক নিষেধ ও হারাম। আজকে আল্লাহর দাওয়াতেই সাড়া দিতে হবে। তিনি পুরস্কৃত করবেন আজকে তাদের যারা সিয়াম সাধনা করেছে, রাতে ইবাদত করেছে, আল্লাহকে স্মরণ করেছে, তার হুকুম পালন করেছে।
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন—‘যখন তাদের (রোজাদার বান্দাদের) ঈদের দিন হয় অর্থাত্ ঈদুল ফিতরের দিন, তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদার বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাগণের সঙ্গে গর্ব করে জিজ্ঞাসা করেন, হে আমার ফেরেশতাগণ! বল দেখি, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হবে? ফেরেশতাগণ বলেন, হে প্রভু! পূর্ণরূপে তার পারিশ্রমিক দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা-বান্দীরা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছে, অতঃপর আমার কাছে দোয়া করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে (ঈদগাহে) গমন করেছে। আমার সম্মান, মর্যাদা, দয়া, বড়ত্ব ও মহানত্বের কসম, জেনে রাখ— আমি তাদের দোয়া কবুল করব। অতঃপর বলেন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা এখন যেতে পার, আমি তোমাদের পাপগুলোকে নেকির দ্বারা পরিবর্তন করলাম। নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। (বায়হাকি)
হুজর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন ফেরেশতাগণ ঈদগাহের পথে বিভিন্ন অংশে দাঁড়িয়ে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করতে থাকেন, হে মুসলমানগণ! তোমরা আপন করুণাময় মহান পরোয়ারদিগারের দরবারে উপস্থিত হও। তিনি আপন দয়া ও মেহেরবানিতে নেক আমল ও ইবাদতের তাওফিক দান করেন অতঃপর এর বিনিময়ে বিরাট পুরস্কারে ভূষিত করেন। তোমাদিগকে ইবাদত-বন্দেগির জন্য হুকুম করা হয়েছে; তোমরা তা পূরণ করেছ। তোমাদিগকে রোজার হুকুম করা হয়েছে; তোমরা তাও পূরণ করেছ—এভাবে তোমরা তার আনুগত্য করেছ। অতএব, এখন তোমরা তোমাদের প্রাপ্য বিনিময় ও পুরস্কার নিয়ে যাও। অতঃপর ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পর ফেরেশতাগণ ঘোষণা করেন, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তোমাদিগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে সফলকাম ও কৃতকার্য অবস্থায় বাড়িতে ফিরে যাও। এভাবেই এ দিনটির নাম হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’। ঊর্ধ্ব জগতেও এই দিনটিকে একই নামে অভিহিত করা হয়। তরগিব তরহিব : ২/৩৮৮।
ঈদের নামকরণ : ‘ঈদ’ ইয়াদুন ধাতু থেকে নির্গত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ বারবার প্রত্যাবর্তন করা। প্রতি বছরই নিয়মিতভাবে দু’বার করে এর আগমন ঘটে; তাই এর নামকরণ হয় ‘ঈদ’।
কেউ কেউ বলেছেন, এদিনে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ রহমত সহকারে বান্দার প্রতি রুজু করেন তথা প্রত্যাবর্তন করেন ও রহমতের দৃষ্টি করেন; তাই এর নামকরণ হয়েছে ‘ঈদ’। (মোজাহেরে হক : ২য় খণ্ড, ২৭৭ পৃ.)।
কেউ কেউ বলেছেন, প্রতি বছরই ঈদ প্রত্যাবর্তন করে ফিরে আসুক; উম্মত এর দ্বারা বারবার উপকৃত হোক—এই শুভ কামনার দিকটি লক্ষ্য করে এর নামকরণ হয় ‘ঈদ’।
আর ‘ফিতর’ শব্দটি অর্থ হলো—রোজার অবসান। দীর্ঘ মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার বিপরীতে এই ফিতর শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (আশি’অ্যাতুল্লাম’আত : ২য় খণ্ড, ৬৬০ পৃ.)।
ঈদের রাতের ফজিলত : হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈদের রাতে সওয়াবের নিয়তে ইবাদত-বন্দেগি করে, তার অন্তর সেই দিনও মরিবে না যেইদিন অন্য লোকের অন্তর মরে যাবে, অর্থাত্ কিয়ামতের দিন। —তরগিব, তরহিব।
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাতকে ইবাদতের মাধ্যমে জিন্দা রাখে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।
১. ৮ জিলহজের রাত, ২ আরাফাতের রাত, ৩. ঈদুল আজহার রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত, ৫. ১৫ শাবানের রাত। —তরগিব, তরহিব।
ইসলামে ঈদের প্রবর্তন : ইসলামে ঈদের প্রবর্তন হয়— হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় গিয়ে দেখতে পেলেন, পারসিক প্রভাবে মদিনাবাসীরা তখনও শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উত্সব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহরিজান উত্সব নিয়মিতভাবেই উদযাপন করছে। এই উত্সবগুলোতে তারা বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দমেলা করত। যা সম্পূর্ণ ইসলামী রীতিনীতির পরিপন্থী এবং বিজাতীয় আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাই হুজুর আলাইহিস ছালাতু ওয়াস সাল্লাম মুসলমানদের ওই উত্সব দুটি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন— আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওই দুই উত্সবের বিনিময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন, এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উত্সব পালন কর।
এতদ্ব্যতীত হিজরি দ্বিতীয় সালে মাহে রমজান খতম হওয়ার দু’দিন আগে ঈদুল ফিতর ও ছদকা-ফিতর সংক্রান্ত একটি আয়াত নাজিল হয়।
হজরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) ও আল্লামা আবুল আলিয়া (রহ.) ওই আয়াতের তাফসির ও তরজমা এভাবে করেছেন— নিশ্চয় সাফল্য অর্জন করেছে সেই ব্যক্তি, যে ছদকা-ফিতর দান করেছে এবং ঈদের নামাজ পড়েছে। (আহকামুল কোরআন : জাসসাছ : খণ্ড ৩, পৃ. ৪৭৩)।
এমনিভাবে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষেই ঈদুল আজহার নামাজ ও কোরবানি সংক্রান্ত নিম্নোক্ত আয়াতটি নাজিল হয়।
হজরত হাসান বছরি (রহ.) বলেন— ওই আয়াতে ঈদুল আজহার নামাজ ও কোরবানির নির্দেশ দান করা হয়েছে। (আহকামুল কোরআন : জাসসাছ : খণ্ড ৩, পৃ. ৪৭৫)।
ঈদের তাত্পর্য : বিশ্বের প্রতিটি জাতির জন্য বছরের মধ্যে এমন কয়েকটি দিন আছে, যেগুলোকে তারা নিজেদের কোনো না কোনো জাতীয় উত্সবের স্মরণীয় দিন হিসেবে গণ্য করে থাকে। এই দিনগুলোতে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও অনুষ্ঠানের প্রচলন তাকে। সভ্য-অসভ্য প্রত্যেক জাতির মধ্যেই এই প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়।
অন্যান্য সাধারণ দিনের তুলনায় এই দিনগুলোতে পোশাক-পরিচ্ছদ ও মেলামেশার পদ্ধতির মধ্যেও বেশ একটা পরিবর্তন ও স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত, এই ধরনের আচার-অনুষ্ঠান নেহায়েত একটা স্বভাবসুলভ এবং সরল-সহজ বিষয় ছিল। কিন্তু মানবপ্রবৃত্তির বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এসব আনন্দ-উত্সব সাধারণত ইন্দ্রিয়জ কামনা-বাসনা পূরণ এবং ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ-সম্ভোগ অর্জনের উদ্দেশ্যেই উদযাপিত হয়ে থাকে। আবার অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত লাভ ও মুনাফার উদ্দেশ্যে, অনেকেই নিছক অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে এবং কেউ কেউ বিশেষ চাঁদা ও নজর-নিয়াজ অথবা স্বীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের লক্ষ্যে এসব উত্সব অনুষ্ঠান করে থাকে। ফলে এর কোনো সার্থকতা ও তাত্পর্য অবশিষ্ট থাকেনি।
উম্মতের প্রতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে প্রচুর এহসান ও অনুগ্রহ রয়েছে, সেগুলোর একটি এটাও যে, তিনি এসব আচার-অনুষ্ঠান ও মেলাগুলোর আমুল পরিবর্তন ও সংশোধন করেছেন। মূলত এসব অনুষ্ঠান মানবের স্বভাবগত বিষয়। তাই তিনি এগুলোর মূলোত্পাটন না করে অন্যান্য ইসলামী রীতিনীতির মতো এ উত্সব ও অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং সৃষ্টিসেবা, মানবতাবোধ এবং পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতা এবং এমনি ধরনের নানা শিক্ষা ও সবকের প্রবর্তন করেছেন। তাই সর্বপ্রথম তিনি তকবিরকে ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য ‘আকবর’-এর চেয়ে উত্তম ও উপযুক্ত কোনো শব্দই হতে পারে না। এমনিভাবে সর্বগুণ সমন্বয়কারী হওয়ার জন্য ‘আল্লাহু’ শব্দের ওপরে আর কোনো শব্দ নেই। তাই তিনি তকবিরের জন্য এ শব্দদ্বয়কে নির্বাচন করেছেন। মানুষ সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে না ওঠে সেজন্য তিনি দিনের শুুরুভাগে নামাজের ব্যবস্থা করেছেন। ঈদের এ জামাতে ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, শিক্ষিত-মুর্খ সবারই একসঙ্গে শরিক হয়ে করুণাময়ের কাছে শ্রদ্ধা নিবেদনের সংবিধান দিয়েছেন। মানবতাবোধ ও পারস্পরিক সহমর্মিতার জন্য সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করেছেন। ঈদের জামাতের আগেই সেই ছদকায়ে ফিতর দান করার জন্য উদ্বুদ্ধও করেছেন। ঈদুল আজহায় উত্কৃষ্টতম খাদ্য গোশত বণ্টনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সবাই চেষ্টা করে থাকে সমাজের অক্ষম ব্যক্তিদের যথাসাধ্য সাহায্য ও সহানুভূতি করতে। কেউ যেন বাদ না পড়ে, বঞ্চিত যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য করেই প্রবর্তিত হয়েছে জাকাতের বিধান। তাই নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা যত্নবান হয় এই দিনের গরিবের দুঃখ ঘোচাতে, এতিমের মুখে হাসি ফুটাতে।
মোটকথা, সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি মানুষের কর্তব্যবোধ ও খেদমতে খালকের নিষ্ঠা ও চেতনাকে জাগ্রত করে এটাকে বাস্তবায়ন করার মহান উদ্দেশ্যেই ঈদের দিনগুলোতে উপরোক্ত খোদায়ী বিধানগুলোর প্রবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে ঈদের তত্ত্ব, তাত্পর্য ও হেকমত। বলাবাহুল্য, ইসলামের এই আদর্শের দৃষ্টান্ত অন্য কেনো জাতি বা ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে মোটেও দেখা যায় না।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে : ‘প্রত্যেক জাতিই ঈদ উদযাপন করে; কিন্তু আমাদের (বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত) ঈদ হচ্ছে এ-ই।’
ঈদের দিনের ১৩টি সুন্নত : ১. শরিয়তের সীমার ভেতর থেকে সাধ্যানুযায়ী সজ্জিত হওয়া, ২. মেসওয়াক করা, ৩. গোসল করা, ৪. সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম (অথবা ধৌত করা) পোশাক পরিধান করা, ৫. খোশবু (সেন্ট নয়, আতর) ব্যবহার করা, ৬. অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা, ৭. ফজরের নামাজের পর অতি শিগগিরই ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া, ৮. ঈদুল ফেতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগে খোরমা অথবা অন্য কোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া, ৯. ঈদুল ফেতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগেই ছদকায়ে ফেতর আদায় করে দেয়া।
১০. কোনো ওজর অসুবিধা না থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে না পড়ে (ঈদগায়ে) ময়দানে পড়া। ওজর অসুবিধা বলতে— অনবরত বৃষ্টি থাকা, অসুস্থতার দরুন দূরের ময়দানে যেতে না পারা ইত্যাদিকে বোঝায়।
১১. ঈদগাহে একপথে যাওয়া এবং অন্যপথে ফিরে আসা। ১২. ঈদগায়ে হেঁটে যাওয়া। ১৩. ঈদগায়ের পথে-ঈদুল ফেতরে অনুচ্চস্বরে এ তকবির পড়তে পড়তে যাওয়া : আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা’ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ।
৮২০
০
০
কোন তথ্যসূত্র নেই
বিবাহ সম্পর্কিত কতিপয় মাসলা-মাসায়েল ও বিবাহের সুন্নত বিষয়ক আলোচনা: যে......
দুই ঈদের নামাযের বিবরণ হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স)......
ঈদুল ফিতর : তাত্পর্য ও বিধান হিজরি সালের শাওয়াল মাসের......
ঈদুল ফিতর (আরবি: عيد الفطر অর্থাৎ "রোযা ভাঙার দিবস") ইসলাম......