সংবাদ :
জাতীয় : জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত- বাংলাদেশের আকাশে আজ পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে, ১০ জুলাই রবিবার সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে ইসলামিক বিশ্ব : আরাফাতে খুতবা দিবেন শায়খ ড. মুহাম্মাদ আবদুল করীম , হজের খুতবা সরাসরি সম্প্রচার হবে বাংলাসহ ১৪ ভাষায় আন্তর্জাতিক : আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৩য় স্থান অর্জনকারী সালেহ আহমদ তাকরিমকে সংবর্ধনা প্রদান করল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন

  • টেক্সট সাইজ
  • A
  • A
  • A
  • |
  • রং
  • C
  • A
  • A
  • A

মায়ানমারে মুসলিম গণহত্যার সেই হৃদয়বিদারক ইতিহাস ! !
প্রিন্ট
প্রকাশঃ : রবিবার ১৬/০৭/২০১৭

রোঁয়াই, রোহিঙ্গা এবং রোসাঙ্গ শব্দগুলো পরিমার্জিত হয়ে বাঙালি কবিদের কাছে রোসাঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের কাছে রোয়াং হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

রোয়াং কিংবা রোসাঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ নানা মত পোষণ করে থাকেন। কিছু ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন, ‘আরাকানের পূর্বতন রাজধানী ম্রোহং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াং, রোহাংগ, রোসাংগ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। চট্টগ্রামীদের কাছে, এমনকি আরাকানের রোহিঙ্গাদের কাছে ম্রোহাং পাথুরী কিল্লা বলে পরিচিত।

১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে নরমিখলা নামে আরাকানের জনৈক যুবরাজ মাত্র ২৪ বছর বয়সে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজধানী ছিলো লেম্ব্রো নদীর তীরে লংগ্রেত। সিংহাসনে আরোহণ করেই নরমিখলা একজন দেশীয় সামন্তরাজার ভগ্নিকে অপহরণ করে রাজধানী লংগ্রেতে নিয়ে আসেন। ফলে আরাকানের সামন্তরাজাগণ একত্রিত হয়ে বার্মার রাজা মেঙশো আইকে আরাকান দখল করার জন্য অনুরোধ জানান। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করলে নরমিখলা পালিয়ে তদানিন্তন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহী রাজবংশ গৌড় থেকে বাংলা শাসন করতো।

জনশ্রুতি রয়েছে, নরমিখলা গৌড়ে এসে সুফী হযরত মুহম্মদ জাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি নামক জনৈক বিখ্যাত কামিল ব্যক্তির কাছে এসে আশ্রয় নেন।

নরমিখলা সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরকাল গৌড়ে অবস্থান করেন এবং ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতা ও রাজনীতি অধ্যয়ন করেন। “He turned away from what was Buddhist and familiar to what was Muslim.”

চব্বিশ বছর পর ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহ মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্যবাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে স্বীয় রাজ্য আরাকান উদ্ধারের জন্যে সাহায্য করেন।

উল্লেখ্য, নরমিখলা ইতোমধ্যে নিজের বৌদ্ধনাম বদলিয়ে মুহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। ফলে বার্মার ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ সোলায়মান (মংস মোয়ান) হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। গৌড়ীয় সৈন্যের সহায়তায় নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান অধিকার করে ম্রাউক-উ নামক এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠান করেন। আর এ সাথে শুরু হয় বঙ্গোপসাগরে উপকূলে এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার।

“In this way Arakan became definitly oriented towards the Moslem states, contact with a modern Civili“ation resulted in renaissance. The Country’s great age began.”

অর্থাৎ- এভাবে আরাকান নিশ্চিতভাবে মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে, একটি আধুনিক সভ্যতার সাথে এই সম্পর্ক আরাকানে এনে দেয় এক রেনেসাঁ। আরাকানী জাতির এক মহাযুগ শুরু হয়।

১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান অধিকার করার এক বছরের মধ্যে ওয়ালী খান বিদ্রোহ করে নিজেই আরাকান দখল করে নিলে পর গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহ সেনাপতি সিন্ধিখানের নেতৃত্বে আবার ত্রিশ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে সোলায়মান শাহকে (নরমিখলা) সাহায্য করেন। সিন্ধি খানের নামে একটি মসজিদ এখনো ম্রোহং বা পাথুরী কিল্লাতে রয়েছে। অতঃপর সকল গৌড় থেকে আগত সৈন্যরা আরাকানেই বিশেষ রাজকীয় আনুকূল্যে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধি খানের সহযোগিতায় সোলায়মান শাহ পিতার রাজধানী লংগ্রেত থেকে ম্রোহং নামক স্থানে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ম্রাউক-উ বংশের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান গৌড়ের সুলতানদের কর প্রদান করতো।

১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে সোলায়মান শাহর দ্বাদশতম অধঃস্তন পুরুষ জেবুক শাহ (মিনবিন) ম্রোহং-এর সিংহাসনে আরোহণ করে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এবং জেবুক শাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্রাউক-উ-সাম্রাজ্য।

“With him (Zabukshah) the Arakanese graduated in their Moslem studies & the Empire was founded. উল্লেখ্য, ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শেখের কিছু কাল বাদ দিলে আরাকান ম্রাউক-উ রাজবংশের শাসনাধীন ছিলো। এ সময়ে প্রায় প্রত্যেক রাজা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করেছেন। ফারসী সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হয়। গৌড়ের মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম ও অভিষেক কাল এবং অপরপিঠে মুসলমানদের কালিমা শরীফ আরবী হরফে লেখা হয়।

রাজার সৈন্যবাহিনীতে অফিসার থেকে সৈনিক পর্যন্ত প্রায় সবাইকে মুসলমানদের মধ্য থেকে ভর্তি করানো হতো। মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশই মুসলমান ছিলো। কাজী নিয়োগ করে বিচারকার্য পরিচালিত হতো।

অপর এক রাজা সেলিম শাহ বার্মার মলমিন থেকে বাংলার সুন্দরবন পর্যন্ত বিরাট ভূভাগ দখল দিল্লির মোঘলদের অনুকরণে নিজেকে বাদশাহ উপাধিতে ভূষিত করেন। নিঃসন্দেহে তদানিন্তন শ্রেষ্ঠ সভ্যতা তথা মুসলিম আচার-আচরণ অনুকরণে এসে আরাকানের সমাজ জীবন পরিচালিত হয়েছে সুদীর্ঘ প্রায় চারশ’বছরকাল। যাকে রোসাঙ্গ সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

এদিকে খ্রিস্টীয় ৮ম/৯ম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজারা আরাকান শাসন করতো। উজালী ছিলো এ বংশের রাজধানী। বাংলা সাহিত্যে যা বৈশালী নামে খ্যাত। এ বংশের উপাখ্যান রাদ জা’তুয়ে’তে নিম্নরূপ একটি আখ্যান উল্লেখ আছে। কথিত আছে, এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্ব কালে (৭৮৮-৮১০ খ্রিস্টাব্দ) কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে পর রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান। আরবীয় মুসলমানগণ স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জনশ্রুতি আছে, আরবীয় মুসলমানেরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে পর ‘রহম’ ‘রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে।

বলাবাহুল্য, ‘রহম’ একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ ‘দয়া করা’। কিন্তু জনগণ মনে করে এরা রহম জাতির লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। সুপ্রসিদ্ধ আরব ভৌগোলিক সুলায়মান ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে রচিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ; নামক গ্রন্থে বঙ্গোপসাগরের তীরে রুহমী নামক একটি দেশের পরিচয় দিয়েছেন। যাকে আরাকানের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা যেতে পারে।

কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় শাহপরীর দ্বীপ বলে একটি স্থান রয়েছে। টেকনাফের অদূরে আরাকানের মংডু শহরের সন্নিকটস্থ সুউচ্চ দুটি পাহারের চূড়ার একটির নাম হানিফার টংকী এবং পাশ্ববর্তী অপরটি কায়রা পরীর টংকী বলে খ্যাত। আরাকানে জনশ্রুতি আছে, ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ছেলে হযরত মুহম্মদ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ইয়াজীদের সাথে দন্দ্ব হওয়ার কারণে আরাকানে আসেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পর ইতিহাসে হযরত মুহম্মদ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায়নি।

অপরদিকে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল হতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত তৎকালীন সময়ের পূর্ব হতেই আরব বণিকদের যোগাযোগ থাকার প্রমাণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি রয়েছে।

কক্সবাজার জেলায় বসবাসকারী জনগণ সাধারণ নিজেদের আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে করে থাকেন। এই এলাকার জনগণের ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না সূচক শব্দ ব্যবহার আরবী ভাষার প্রভাবের ফল বলে পন্ডিতগণের ধারণা। কক্সবাজারের জনগণের ভাষায় প্রচার আরবী ও ফারসী শব্দ এবং মঘী শব্দের আধিক্য দেখা যায়। মঘী জরিপের অনুরূপ অত্র এলাকার জমির পরিমাণ দ্রোন, কানী ও গণ্ডা ইত্যাদি হিসেবে হয়ে থাকেন। অপরপক্ষে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গৌড়ীয় পরিমাপ অনুসারে বিঘা, কাঠা ও পাখি হিসেবে হয়ে থাকে।

নিঃসন্দেহে কক্সবাজারের জনগণের উপর এটি রোসাঙ্গ সভ্যতার প্রভাবের ফল। অনেক ডাক ও পর্তুগীজ শব্দও জনগণের ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। আরো দেখা যায়, পর্তুগীজ নাম ফারনানডেজ বিকৃত হয়ে পরান মিয়া, ম্যানুয়েল বিকৃত হয়ে মনু মিয়া হয়েছে।

অনেক ডাচ পর্তুগীজ সন্তান ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে- এমন ঘটনা নিয়ে একটি গল্প ডাচ ইতিহাসে পাওয়া যায়। ঘটনাটি হলো- আরাকানের ম্রাউক-ই রাজবংশের রাজত্বকালে কোন বিদেশী ইচ্ছা করলে আরাকানী রমণীদের বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু আরাকান থেকে চলে যাওয়ার সময় আরাকানী স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যেতে পারতো না।

“This prohibition often constituted a serious hardship in individual cases and we find Europeans resorting to all sorts of expedients to smuggle their families out of the country. There were cases of wives being hidden in large martaban jars and Smuggled on board ship. The Pious Dutch Calvinists were also not a little worried because their children left in Arakan were brought up to be Muslims.

অর্থাৎ- আরাকানে অবস্থানরত ডাচগণের ফেলে যাওয়া সন্তান-সন্তুতি মুসলমান হয়ে যায় বিধায় চলে যাওয়ার সময় বড় বড় মটকায় স্ত্রী-পুত্রদের লুকিয়ে আরাকান থেকে নিয়ে যেত। এ ঘটনাটি নিঃসন্দেহে তদানিন্তন আরাকানের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থান কেমন ছিল তা জানতে আমাদের সাহায্য করে। অর্থাৎ ইসলামই ছিলো তৎকালীন আরাকানের সমাজ জীবনে মূল প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি। মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গের জনগোষ্ঠীর একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন, “নানাদেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে। আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাবসী ও রুমী, খোরসানী,উজবেগী সকল। লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দি, কামরূপী আর বঙ্গদেশী। বহু শেখ,সৈয়দজাদা, মোগল, পাঠান যুদ্ধা রাজপুত হিন্দু নানাজাতি। (পদ্মাবতী : আলাওল)

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রোহিঙ্গারাই ইতিহাস প্রসিদ্ধ রোসাঙ্গ সভ্যতার ধারক বাহক। তবে এটুকু বলা চলে, নানা জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই রোহিঙ্গা জাতি।

১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা আরাকান দখল করে নিলে পর আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগরা পালিয়ে আসে। এটাই যুক্তিসঙ্গত যে, বৌদ্ধদের সাথে সাথে মুসলমানরাও লাঞ্ছিত হতে থাকে। কোন স্থানে দুর্যোগ আসলে উক্ত এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক অনুরূপ অত্যাচারের শিকার হতে বাধ্য।

অতএব, মগদের সাথে সাথে মুসলমানরাও চলে আসে। তবে তফাৎ হলো মগেরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় গভীর জঙ্গলে আর মুসলমানেরা সমুদ্র পথে হিজরত করে এসে আশ্রয় নেয় স্বধর্মীয় চট্টগ্রামের মুসলমানদের কাছে। আরাকান থেকে আগত মুসলমান স্থানীয় মুসলমানদের কাছে এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং এখান থেকেই শুরু হয় অতীতের রোয়াই ও চাড়িগ্রাই (চট্টগ্রামী) দুই জনগোষ্ঠীর বিবাদের ইতিহাস।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রোঁয়াই শব্দটি রোসাঙ্গ হতে অভিন্ন। একই এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন দুই ধরনের ভাষা হতে পারে না। যেমন একজন উখিয়া থানার বসবাসকারী লোককে একজন মহেশখালী থানায় বসবাসকারী লোক থেকে চেহারার কারণে পৃথক করে নেয়ার উপায় নেই। তবে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে লোকটির পূর্বপুরুষ রোঁয়াই নাকি চাড়িগ্রাই (চট্টগ্রামী)।

আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, বাঁশখালী থানার কোন লোককে রাউজান থানার কোন লোক থেকে চেহারার জন্যে আলাদা করে নেয়া যাবে না। কিন্তু বাঁশখালীর চট্টগ্রামী কোন পল্লীর লোককে রোঁয়াই পল্লীর লোক থেকে ভাষার কারণে আলাদা করে নেয়া যাবে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।

১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়।

মুসলিম গণহত্যার সূত্রপাতঃ

তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তারা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকুও দেয়নি।



নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ ]সেখানে তারা সংখ্যালঘু। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।



নতুন করে ভয়াবহ মুসলিম নিধন অভিযান

যুগ যুগ ধরে মুসলিম নিধনের ধাবাহিকতায় গত ৩ জুন থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যা শুরু করেছে সন্ত্রাসী রাখাইন বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ মহিলা নির্যাতনের অজুহাতে তারা এ গণহত্যার সূচনা করে। শুরুতেই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করে। গত রোববার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের তুয়ানগোকিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম রোহিঙ্গারা জুমুয়াবার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করলে ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে যায়।

মিয়ানমারের আকিয়াব শহরের রামবী গ্রামের এক রাখাইন শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্র পিঠানোকে কেন্দ্র করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গালিগালাজ ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এতে এক শিক্ষিকা মারা যায়। এরই জের ধরে আকিয়াব শহর থেকে গাড়িযোগে একদল রোহিঙ্গা মুসলিম ইয়াঙ্গুন যাওয়ার পথে ৩ জুন টংগু নামক স্থানে পৌঁছলে রাখাইন যুবকেরা গাড়ির হেলপারসহ ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে। ড্রাইভার কৌশলে পালিয়ে গিয়ে টংবু ইমিগ্রেশনকে অবহিত করে।

নির্মম এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে ৫ জুন বাদ যোহর ও আছরের নামায শেষে মুসলমানরা ইয়াঙ্গুন শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ ঘটনায় মুসলিম অধ্যুষিত পুরো আরাকান রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াঙ্গুনে শীর্ষ মুসলিম নেতারা বৈঠক করে। ৮ জুন শুক্রবারে জুমুয়ার নামাযে মুসলমানদের জমায়েত করে শান্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৮ জুন পুরো আরকানে জুমুয়ার নামাযে মুসল্লীরা সমবেত হতে থাকে। মংডু শহরের মসজিদে জুমুয়ার নামায চলাকালে মংডুয়ে বৌদ্ধদের ইউনাইটেড হোটেল থেকে মসজিদে ও মুসল্লীদের উপর পাথর নিক্ষেপ শুরু করে ।

অতঃপর রাখাইন বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপর হামলা শুরু করে। হাজার হাজার মুসলমানদের শহীদ করা শুরু করে। মসজিদ-মাদরাসা, ঘর-বাড়ি পোড়ানো শুরু করে। সরকারি মদদে কারফিউ জারি করে সেনা, পুলিশ ও নাসাকা বাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলমানদের গণহত্যা চালাচ্ছে। সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তা খানিকটা একপেশে ও তথ্য গোপনের অপচেষ্টায় দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ প্রকাশিত খবরে এ দাঙ্গার মূল ঘটনা আড়ালে চলে গেছে এবং দাঙ্গার প্রকৃত উৎসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বৌদ্ধদের প্রাধান্য থাকায় দেশটির প্রচারমাধ্যম তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুসলমান বা রোহিঙ্গাদের তেমন খবরদারি নেই সেখানে।

এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এক বার্মিজ নাগরিক বলেছে, রোহিঙ্গা হত্যা একটি ভালো কাজ। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মাতাল হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায় বৌদ্ধ রাখাইনরা। ধর্ষণের ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও এর প্রতিশোধ এত নির্মম হতে হবে? আবার একই প্রশ্নে জর্জরিত রোহিঙ্গারাও। হামলার প্রতিবাদে তারা কেন সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিল? এ প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আশ্রয় নেয়ার কোন বিকল্প নেই। ধর্ম ও জাতিগত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে এর উত্তর পাওয়া যাবে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গার প্রকৃতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু হলেও তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কখনও প্রকাশ করেনি মিয়ানমার সরকার। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জাতিসংঘ নিযুক্ত মিয়ানমারের বর্তমান প্রতিনিধি ইয়ে মিয়িন্ট অংয়ের উদ্ধৃতি থেকে।

সে মুসলমান ধর্মানুসারী রোহিঙ্গাদের ‘বন্য ও বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া সেই ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু বলে ঘোষণা করে আসছে। তাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি আদিগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিয়ানমারের কোন সম্পর্ক নেই। সে মতামত প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার সরকার তাদের উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালায়, যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা দাসত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এদের এ নাজুক পরিস্থিতি দেখে মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়ারস বলেছে, পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ মিয়ানমারের সব মিলিয়ে ১৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মান্ধ সামরিক জান্তাদের চোখে রোহিঙ্গা মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীতে পরিগণিত হয়।

ফলে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় মুসলমান আদিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঠেকাতে তাদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের সাধারণত স্থানীয়ভাবে ‘কালারস’ নামে অভিহিত করা হয়। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের ‘দ্য ভয়েস’ নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। সেখানে একজন পাঠক তার মতামত দিতে গিয়ে লিখেছে, আমাদের উচিত কালারস হত্যা করা অথবা ধ্বংস করা, তা না হলে এ দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব মুছে যাবে। এমন উদ্ধৃতি থেকে সহজেই বোঝা যায়, বার্মিজ ও রোহিঙ্গারা ধর্মগত দিক থেকে দ্বান্দ্বিক ও পৃথক সত্তার অধিকারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা চায় সেখানে বৌদ্ধদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সে মতবাদের আলোকে রোহিঙ্গারা ক্ষুদ্র ও ভিনদেশী বলে পরিচিত। দেশটির সাম্প্রতিক অগ্রযাত্রায়ও তাদের কোন স্থান নেই বলে বিশ্বাস করে নেপিডোর সরকার।
 

১৬৬৭

কোন তথ্যসূত্র নেই

আপনার জন্য প্রস্তাবিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশন

To preach and propagate the values and ideals of Islam, the only complete code of life acceptable to the Almighty Allah, in its right perspective as a religion of humanity, tolerance and universal brotherhood and bring the majority people of Bangladesh under the banner of Islam

অফিসিয়াল ঠিকানা: অফিসিয়াল ঠিকানা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শের-এ- বাংলা নগর, ঢাকা -১২০৭