সংবাদ :
জাতীয় : জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত- বাংলাদেশের আকাশে আজ পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে, ১০ জুলাই রবিবার সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে ইসলামিক বিশ্ব : আরাফাতে খুতবা দিবেন শায়খ ড. মুহাম্মাদ আবদুল করীম , হজের খুতবা সরাসরি সম্প্রচার হবে বাংলাসহ ১৪ ভাষায় আন্তর্জাতিক : আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৩য় স্থান অর্জনকারী সালেহ আহমদ তাকরিমকে সংবর্ধনা প্রদান করল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন

  • টেক্সট সাইজ
  • A
  • A
  • A
  • |
  • রং
  • C
  • A
  • A
  • A

ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ আ
প্রিন্ট
প্রকাশঃ : বুধবার ০৫/০৭/২০১৭

আমাদের সমাজের সকল মানুষ এবং ইসলাম সম্পর্কে যাদের সামান্য জ্ঞানও আছে তারা সকলেই জানেন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্র নির্বিশেষ সমাজের সকল মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রেরণা। তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক ঐতিহাসিকভাবে তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠির সকল মানুষই ধর্মীয়ভাবে শান্তিপ্রিয়। সবাই আমরা শান্তি চাই। এখন সমস্যা হলো, তাহলে ইসলামের নামে বোমাবাজি, অশান্তি, নিরিহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা, আত্মহত্যা ইত্যাদি কেন ঘটছে? সকল ঘটনার কারণ জানা শুধু কৌতুহল নিবারণের বিষয় নয়, বরং সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়। সন্ত্রাস একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি। এর নিরাময়ের জন্য এর সঠিক কারণ নির্ণয় করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক কারণ নির্ণয় এই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ের পথ সুগম করবে। পক্ষান্তরে এর কারণ নির্ণয়ে বিভ্রান্তি সমস্যাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।

ইসলামের নামে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সারা বিশ্বে অমুসলিম মুসলিম গবেষক-বুদ্ধিজীবীগণ জঙ্গিবাদের যে সকল কারণ উল্লেখ করছেন সেগুলির অন্যতম হলো: () ইসলাম, () ইসলামী শিক্ষা, () ওহাবী মতবাদ () পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র।

আলোচিত প্রথম কারণ: ইসলাম

অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম ধর্মকে দায়ী করেন। তাদের মতে ইসলাম তার অনুসারীদের অসহিষ্ণুতা জঙ্গিবাদ শিক্ষা দেয়। ইসলামে জিহাদের নামে অমুসলিমদেরকে হত্যা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এর ফলেই মুসলিমদের মধ্যে জঙ্গিবাদের উত্থান। তাদের মতে ইসলামী সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ বন্ধ করার একমাত্র উপায় ইসলাম ধর্মকে নির্মুল অথবা নিয়ন্ত্রণ করা। এরা দাবি করেন যে, ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত আবশ্যম্ভাবী। একে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের উত্থানসভ্যতার সংঘাততত্ত্বের সঠিকত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

এক্ষেত্রে মানব সভ্যতার সংরক্ষণের জন্য এই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো, শক্তির মাধ্যমে এদেরকে হত্যা করা, বন্দি করা মুসলিম দেশগুলিকে সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। বিশেষত, ইসলামী শিক্ষার বিস্তার রোধ করা। সকল গবেষক-পণ্ডিতদেরকে হয়ত মুসলিমগণইসলাম-বিদ্বেষীবলে মনে করতে পারেন, তবে এদের অনেকের ক্ষেত্রেই এরূপ মতপ্রকাশের জন্য বিদ্বেষের চেয়ে অজ্ঞতাই বড় কারণ। এদের অনেকেই ইসলামের জিহাদ বিষয়ক কিছু নিদের্শ হয়ত পাঠ করেছেন, কিন্তু জিহাদের প্রকৃত অর্থ, শর্ত বা বিধানাবলি জানেন নি। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম ধর্ম-প্রচারক বা ধর্মগুরুদের প্রচারণামূলক বইপুস্তকই পাঠ করেছেন, ইসলামী জ্ঞানের সূত্রগুলি থেকে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন নি। এরা দেখছেন যে, কোনো কোনো মুসলিম নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে এবং এজন্য তারা ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের উদ্ধৃতি পেশ করছে কাজেই তাঁরা ধারণা করেন যে, কুরআন এইরূপই শিক্ষা দিয়ে থাকে। এভাবেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এই জঙ্গিবাদের জন্য ইসলামই দায়ী এবং ইসলামকে নির্মুল বা নিয়ন্ত্রণ করাই এই সমস্যা দূরীকরণের একমাত্র উপায়।

পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত, যারা বিভিন্ন মুসলিম সমাজ জনগোষ্ঠির সাথে সুপরিচিত বা ইসলাম ধর্ম ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা পরিচিত, তারা উপর্যুক্ত মতামত পুরোপরি সমর্থন করেন না। তারা মনে করেন, ইসলামে অনেক ভাল কথা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সহঅবস্থান সম্ভব। তবে ইসলামের মধ্যে ভাল বিষয়ের সাথে জিহাদ, ধর্মত্যাগ, বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ক কিছু উগ্র অসহিষ্ণু বিষয়ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেগুলি মানবাধিকার বা সভ্যতার সহঅবস্থান বা বিকাশের বিপক্ষে। সকল শিক্ষা থেকেই জঙ্গিবাদের জন্ম। এজন্য জঙ্গিবাদ দমনের জন্য ইসলামেরভাল শিক্ষাগুলিরপ্রসংশা করতে হবে সেগুলির বিকাশ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি উগ্র বাখারাপশিক্ষার বিস্তার রোধ করতে হবে। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। থেকেউগ্রতাউৎসাহ দিতে পারে এরূপ শিক্ষা বাদ দিতে হবে। এভাবে মুসলিম সমাজগুলিতেমডারেটমুসলিমদের উত্থান ঘটাতে পারলেই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আলোচিত দ্বিতীয় কারণ: ইসলামী শিক্ষা

বিশ্বের ধার্মিক বা অধার্মিক কোনো মুসলিমই উপর্যুক্ত মতামতদ্বয় সঠিক বলে মানতে পারেন না। বরং তারা একে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং বিদ্বেষমূলক মত বলে বিশ্বাস করেন। তাঁরা অনুভব করেন যে, যদি ইসলাম ধর্মই জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী হতো তবে আমরা সকল মুসলিমই আমাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের আগ্রহ বা প্রেরণা অনুভব করতাম। মুসলিম পরিবারে বা সমাজে লালিত পালিত সকল ধার্মিক বা অধার্মিক মুসলিমই ইসলাম সম্পর্কে কমবেশি কিছু শিক্ষা পরিবার, প্রতিষ্ঠান বা সমাজ থেকে পেয়েছেন। কিন্তু কখনোই তারা অমুসলিম বা অন্যান্য মতাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতার শিক্ষা পান নি। সকল মুসলিম সমাজেই মুসলিমগণ অমুসলিমদের সাথে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছেন। কাজেই জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম কখনো দায়ী হতে পারে না। সমস্যা থাকলে অন্য কোথাও রয়েছে, ইসলামের মধ্যে নয়। তাঁরা অস্বীকার করেন না যে, কিছু মুসলিম সন্ত্রাসের সাথে জাড়িত। তবে তারা কখনোই স্বীকার করেন না যে, তাদের ধর্ম তাদের সন্ত্রাসের জন্য দায়ী। বরং সকল সন্ত্রাসীদের ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি, মানসিক বিক্ষুব্ধতা, সামাজিক অনাচার বা অন্য কোনো কারণ এর পিছনে কার্যকর।

এদের অনেকেই মনে করেন যে, জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য মূলত দায়ী ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার। জঙ্গিবাদের বিস্তারে মাদ্রাসা শিক্ষার এই দায়িত্বের প্রকৃতি নির্ণয়ে সকল পণ্ডিতের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণীর অমুসলিম পাণ্ডিতগণওইসলামী শিক্ষাকেইমূলত জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য দায়ি করছেন। তবেদায়িত্বেরপ্রকৃতি নির্ণয়ে তাদের মধ্যে এবং তাদের সাথে মুসলিম পণ্ডিতদের বিভিন্নতা রয়েছে। কেউ মনে করছেন যেহেতু ইসলামের মধ্যেই জঙ্গিবাদের শিক্ষা রয়েছে, সেহেতু ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রসার মানেই জঙ্গিবাদের প্রসার। যত বেশি কুরআন, হাদীস, ফিক্হ ইত্যাদি ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা প্রসার লাভ করবে, ততই বেশিজিহাদীমনোভাব, অন্য ধর্ম অন্য মতের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব মোল্লাতান্ত্রিক (theocratic) স্বৈরাচারী সরকার জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব প্রসার লাভ করবে। এজন্য ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রসার রোধই জাঙ্গিবাদ দমনের প্রধান উপায়।

অন্য অনেকে মনে করেন যে, ইসলামের মধ্যে মূলত জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই, তবে ইসলামী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসাগুলিতে ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথবা এগুলির পাঠ্যক্রম পাঠ্যসূচী ইসলামকে জঙ্গিবাদী রূপদানের সহায়ক। অথবা ইসলামী আবেগের অপব্যবহার করে সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদেরকে সহজেই জঙ্গিতে রূপান্তরিত করা যায়। কেউ মনে করছেন, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবেই ইসলামের শিক্ষা প্রদান করছে, তবে সম্ভবত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু ত্রটি রয়েছে, যে কারণে এগুলি জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছে। এদের মতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারই জঙ্গিবাদ রোধের উপায়। “It is a fact that some of the Madrasha students have got involved with what is called ‘Islamic’ militancy…. Though Madrasha education may not be held rresponsible for thes most unwanted activities, yet there are some loopholes and it is time to think about bringing Madrasha education into the mainstream.”

`ইসলামী জঙ্গিবাদেরজন্যইসলাম’-কে দায়ী করলে যেমন মুসলিমগণ হতবাক, বিস্মিত, ব্যথিত বা উত্তেজিত হয়ে এইরূপ মতকে বিদ্বেষমূলক বলে মনে করেন, ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসার সাথে জড়িত মানুষরাও এই দ্বিতীয় মতটির বিষয়ে একইরূপ বিস্ময়, ব্যথা বা উত্তেজনা অনুভব করেন।

তাঁরা অনুভব করেন যে, যদি ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষাই জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী হতো তবে আমরা মাদ্রাসার সকল ছাত্র শিক্ষক আমাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের আগ্রহ বা প্রেরণা অনুভব করতাম। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কখনোই তা নয়। সন্ত্রাস, হত্যা ধ্বংসের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা বিরোধিতা অনুভব করছেন সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা আলেম, ইমাম পীর-মাশাইখ। বিগত প্রায় আড়াই শত বৎসর ধরে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা উপমহাদেশে চালু রয়েছে এবং মূলত একই পাঠ্যক্রম পাঠ্যসূচী অনুসরণ করে চলেছে। এছাড়া অনুরূপ পদ্ধতির অগণিত মাদ্রাসা মালয়েশিয়া অন্যান্য মুসলিম দেশে চালু রয়েছে। এগুলি থেকে বের হয়ে আসা অগণিত মানুষ সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করেছেন, কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই তাঁরা সন্ত্রাসের জন্ম দেন নি। তাঁরা অস্বীকার করেন না যে, কিছু মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক এই অপরাধের সাথে জাড়িত; তবে তারা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের এই অপরাধের জন্য দায়ী। বরং তা তাদের ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি।

সকল মাদ্রাসাশিক্ষিত মানুষেরা উপর্যুক্ত পাণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদেরকেইসলামীশিক্ষা বিদ্বেষীবামাদ্রাসা বিদ্বেষীবলে মনে করে থাকেন। তবে আমার কাছে মনে হয়ইসলামী জঙ্গিবাদেরজন্যইসলাম ধর্ম’-কে দায়ী করা এবংইসলামী শিক্ষা’-কে দায়ী করা উভয় মতের পিছনেই মূলত অজ্ঞতা কার্যকর। পাশ্চাত্য অমুসলিম পণ্ডিতগণ যেমন কোনো কোনো মুসলিমকে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত দেখে সন্ত্রাসীর ধর্মকে দায়ী করছেন, তেমনি অনেকে কোনো কোনো মাদ্রাসা শিক্ষিতকে সন্ত্রাসে লিপ্ত দেখে সন্ত্রাসীর শিক্ষাকে দায়ী করছেন। সকল পণ্ডিতের অনেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচিত নন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে তাঁরা জানতে পারেন যে, মাদ্রাসাগুলিতে জঙ্গিবাদীদের আখড়া এবং মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকগণ জঙ্গি কার্যক্রমে লিপ্ত। এথেকে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষাই মূলত জঙ্গিবাদের উত্থান বিস্তারের জন্য দায়ী।

সাধারণভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো অপরাধীর অপরাধের জন্য তার ধর্ম, শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ইত্যাদি সাধারণত দায়ী হয় না। তদুপরি আমি এখানে নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনা করার জন্য পাঠককে অনুরোধ করছি।

() আমাদের সমাজের লক্ষ লক্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক সকলেই আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত। এদের দুর্নীতির জন্য কেউই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন না। কারণ তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেন তারাও একই শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত। তাঁরা ভাল করেই জানেন যে, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনোই দুর্নীতি শিক্ষা দেওয়া হয় না, বরং সততা আদর্শই শিক্ষা দেওয়া হয়। কাজেই দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির জন্য তার ব্যক্তিগত লোভ, সামাজিক অনাচার, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ইত্যাদিই দায়ী; তার ধর্ম, শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এজন্য কোনো অজ্ঞ মানুষ বামাদ্রাসা শিক্ষিতমানুষ দুর্নীতির প্রসারের জন্যআধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাবাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানদায়ী বলে মন্তব্য করলে বা ডাক্তারদেরকসাইসুলভ আচরণের জন্যমেডিকেল কলেজগুলিদায়ী বলে মন্তব্য করলে শিক্ষিত মানুষেরা তাকে মুর্খ বা নির্বোধ বলেই মনে করবেন।

() অনুরূপভাবে আমাদের দেশের অনেক মানুষই সমাজতন্ত্র বাসর্বহারার রাজত্বেরনামে সন্ত্রাসকর্মে লিপ্ত। এরা আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা লাভ করেছেন। কিন্তু কেউই বলবেন না যে, এদের ঘৃণ্য কর্মের জন্য তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দায়ী।

() স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে আমেরিকার প্রশাসন ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান জীবন সম্পদ হারিয়েছেন। তারা নির্বিচার বোমা মেরে ফালুজা অন্যান্য শহরে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষেরগণহত্যাযজ্ঞেলিপ্ত হয়েছেন এবং সম্পদ ধ্বংস করেছেন এবং এরপর কয়েকশত কুর্দীকে হত্যার অপরাধে তারা সাদ্দাম হোসেনের বিচার করছেন। ইরাকী, আরব, মুসলিম বিশ্বের যে কোনো দেশ ধর্মের শান্তিকামী মানুষের দৃষ্টিতে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মানবতার বিরুদ্ধে কঠিনতম অপরাধ। এখানে একজন বিক্ষুদ্ধ ইরাকী, আরব বা মুসলমান এই অপরাধের জন্যখৃস্টধর্ম’, ‘গণতন্ত্রবাআমেরিকান সভ্যতা’-কে দায়ী করে মন্তব্য করতে পারেন; কারণ প্রেসিডেন্ট বুশ তার সহকর্মীবৃন্দবিশ্বাসী ধর্মপরায়ণ খৃস্টান, আমেরিকান সভ্যতার সন্তান গণতন্ত্রের ধারক-বাহক কিন্তু কোনো খৃস্টান, আমেরিকান, গণতন্ত্র প্রেমিক বা কোনো একজন প্রাজ্ঞ পণ্ডিত এই মতের সাথে একমত হবেন না। তারা একে অজ্ঞতা প্রসূত প্রলাপ বলেই মনে করবেন। কারণ তারা জানেন যে, খৃস্টধর্ম, গণতন্ত্র বা আমেরিকান সভ্যতা কোনোটির এইরূপ হত্যাযজ্ঞ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস লুটতরাজ শিক্ষা দেয় না বা সমর্থন করে না। মার্কিন প্রশাসন যা করছেন তা বর্তমান নেতৃবৃন্দের অন্যায়, এরজন্য তাদের ধর্ম, আদর্শ বা সভ্যতা দায়ী নয়।

() ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টিও একই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করা মানুষদের দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করলে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৎ নীতিবান ছাত্রদের কাছে তা পাগলামি বলে মনে হয়, তেমনিভাবে মাদ্রাসা শিক্ষিত কতিপয় মানুষের সন্ত্রাসের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে দায়ী করলেও মাদ্রসা শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সাধারণ মানুষদের কাছে পাগলামি বলেই মনে হয়।

() বর্তমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সম্পৃক্তির মূল বিষয়টিও বিবেচ্য। আমরা দেখেছি যে, সহিংসতা বা সন্ত্রাসে লিপ্ত ব্যক্তি নিজের ধর্ম বা আদর্শকে ব্যবহার করেন। দেশপ্রেম গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে মানুষের গণতান্ত্রিক অনুভূতি মানবাধিকারের প্রতি ভালবাসাকে ব্যবহার (exploit) করা হয়। এভাবেই আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমিক মানবাধিকারবাদী মানুষেরা প্রেসিডেন্ট বুশকে ম্যান্ডেট দিয়েছেন আত্মরক্ষা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইরাকের নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের মধ্যে হত্যাযজ্ঞ চালানোর।

স্বভাবতই ইসলামের নামে সন্ত্রাসে ইসলামী অনুভুতিকে ব্যবহার (exploit) করা হয়েছে হচ্ছে। এতে কোনো কোনো ইসলামপ্রেমিক সরল মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। মাদ্রাসায় পড়া কোনো মানুষ এরূপ প্রতারণার শিকার হতে পারেন না এরূপ দাবি কেউই করেন না। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসে যেমন গণতন্ত্র প্রেমিকরা প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ইসলামের নামে সন্ত্রাসে ইসলাম প্রেমিক মাদ্রাসা ছাত্ররা বেশি প্রতারিত হবে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এর বিপরীত। জঙ্গিরা হয়ত তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নিজেরা কোনোমাদ্রাসাবামসজিদপ্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলি বা মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষেরা দলে দলে সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যোগদান করেছেন।ইসলামী সন্ত্রাসনামক এই জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত মাদ্রাসা শিক্ষিতের সংখ্যা খুবই কম।

সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষয়। এরূপ সংবাদ, গণমাধ্যমীয় গবেষণা-প্রবন্ধ পর্যালোচনার উপর নির্ভর করে আমেরিকার জনগণ নিশ্চিত বিশ্বাস করেছিল যে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র weapon of mass destruction) রয়েছে, যা আমেরিকার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি। আর এজন্যই তারা একবাক্যে প্রেসিডেন্ট বুশকে ইরাক যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছিলেন। আজ লক্ষ লক্ষ মানব সন্তানের রক্ত ঝরানো এবং অমূল্য মানবীয় সম্পদের ধ্বংসলীলার পরে সবাই জানতে পারলেন স্বীকার করলেন যে, এরূপ কোনো অস্ত্র কোনোকালেই সেখানে ছিল না।

সংবাদ মাধ্যমের কারণেই এখনো সবাই জানলেন না যে, এইরূপ অস্ত্র থাকলেও কোনো দিনই ইরাক আমেরিকার স্বাধীনতা বা নিরাপত্তার হুমকি হতে পারত না। শুধু ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার জন্যই এই গণহত্যা। সংবাদ মাধ্যমের কারণেই এশিয়ার সুনামি মহা সংবাদে পরিণত হয়, কিন্তু ফালুজার গণহত্যা মহাধ্বংস কোনো সংবাদই হয় না।

এজন্য গণমাধ্যমের সংবাদ বা তথ্যের উপর নির্ভর করা তো দূরের কথা, সুপ্রশিক্ষিতইন্টেলিজেন্সী সুনিশ্চিত রিপোর্টের উপর নির্ভর করাও কঠিন। সকল তথ্যের বাইরে বাস্তব অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের দেশের আনাচে কানাচে অগণিত মাদ্রাসা ছড়িয়ে রয়েছে। সকল মাদ্রাসার কর্মকাণ্ড সবকিছুই সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এগুলির ছাত্র শিক্ষক সকলেই সমাজের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। এদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসীর অস্তিত্ব আমরা পাই না। মাদ্রাসা শিক্ষিত যে সকল মানুষ জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়েছেন বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি তাদের আনুপাতিক হার স্কুল-শিক্ষিত মানুষদের চেয়ে বেশি নয়। সর্বোপরি আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, এই সন্ত্রাসের উদ্ভবমাদ্রাসা-শিক্ষিত গুরুদেরদ্বারা নয়, বরং সাধারণ-শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিকতা থেকে ধার্মিকতায় রূপান্তরিতগুরুমুফতিদের দ্বারা। এখানে দুই চার জন মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষ প্রভাবক বা প্রতারক নয়, বরং প্রভাবিত প্রতারিত।

() এখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, সমস্যার কারণ নির্ধারণে বিভ্রান্তি অনেক সময় সমস্যা উস্কে দিতে পারে। সন্ত্রাসের জন্য সন্ত্রাসীর জাতি, ধর্ম, গোত্র, দল বা শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করলে মূলত সন্ত্রাসীকে সাহায্য করা হয়। এতে একদিকে সন্ত্রাসীর স্বজাতি, স্বধর্ম, স্বদল বা স্বশিক্ষার মানুষেরা সন্ত্রাসের বিরোধিতার পরিবর্তে সন্ত্রাস বিরোধীদের সাথে বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েন, অপরদিকে পরোক্ষভাবে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসীর প্রতি এক প্রকারেরসহমর্মিতাজন্মলাভ করে। আমরা দেখেছি যে, কোনো কোনো পাশ্চাত্য পণ্ডিত সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী বলে মন্তব্য করে ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাতকেই উস্কে দিচ্ছেন। সন্ত্রাসের জন্য ইসলামী শিক্ষাকে দায়ী করলেও একইভাবে সন্ত্রাসকে উস্কে দেওয়া হবে এবং সন্ত্রাসীদের জন্য সহমর্মী সৃষ্টি করা হবে। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষেরা সন্ত্রাস বিরোধিতার বদলে অপ্রাসঙ্গিক বির্তকে জাড়িয়ে পড়বেন।

সর্বোপরি এরূপ মতামতের ভিত্তিতে যদি সরকার বা প্রশাসন মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ, সংকোচন বা মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ঢালাও কোনো কর্মকাণ্ড হাতে নেন তবে তাতে নতুন এক প্রকারের সহিংসতায় আক্রান্ত হবে দেশ জাতি।

মূলত কোনো ধর্ম, মতবাদ বা আদর্শ সহিংসতা বা সন্ত্রাস শিক্ষা দেয় না। মানুষ মানবীয় লোভ, দুর্বলতা, অসহায়ত্ব, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদির কারণে সহিংসতা বা হিংস্রতায় লিপ্ত হয়। এরূপ সহিংসতায় লিপ্ত ব্যক্তি নিজের কর্মের পক্ষে সাফাাই গাওয়ার জন্য, নিজের বিবেককে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করার জন্য, অন্যকে নিজের পক্ষে টানার জন্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে নিজের আদর্শকে ব্যবহার করে।

এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসকারী আরবদেরকে পূর্ব জেরুযালেম অন্যান্য ফিলিস্তিনী এলাকা থেকে সন্ত্রাস, গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বিতাড়ন করে অন্যান্য দেশে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী ইহূদীদেরকে সেখানে নিয়ে এসে ইস্রায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য ইহূদী-খৃস্টানগণ পবিত্র বাইবেলের বাণীকে ব্যবহার করেছেন। অনুরূপভাবে আইরিশ ক্যাথলিক ব্রিটিশ প্রটেস্ট্যান্টের বিরুদ্ধে নিজের ধর্মমতকে ব্যবহার করেন, তিব্বতীয় বৌদ্ধ চীনের বিরুদ্ধে নিজের বৌদ্ধ ধর্মমতকে ব্যবহার করেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু উচ্চবর্ণের হিন্দুর বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বা ধর্মীয় মতামত ব্যবহার করেন, ফিলিস্তিনী যোদ্ধা ইহূদী দখলদারের বিরুদ্ধে নিজের ইসলাম বা খৃস্টান ধর্ম থেকে উদ্দীপনা বা প্রেরণা লাভের চেষ্টা করেন।

আমাদের সমাজেআওয়ামী লীগেরকর্মী যদি কোনো কারণে উত্তেজিত হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হন তখন তখন তিনিস্বাধীনতা’, বঙ্গবন্ধু, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাইত্যাদি মহান মর্যাদাময় বিষয়কে তার কর্মের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অনুরূপভাবেবিএনপি কর্মী বা সমর্থক এই ক্ষেত্রেশহীদ জিয়া’, জাতীয়তা, স্বাধীনতা ইত্যাদি মহান বিষয়কে নিজেরএক্সকিউজহিসেবে ব্যবহার করেন। উভয় ক্ষেত্রেই দলের অন্যান্য বিচক্ষণ কর্মী জানেন যে, নিজের সহিংসতা বৈধ করার জন্যই এগুলি বলা হচ্ছে।

সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে দায়ী করে মাদ্রাসা শিক্ষা, মাদ্রাসা বা মাদ্রাসা শিক্ষিতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে স্বভাবতই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হবেন এবংইসলামইসলামী শিক্ষা’- বিপন্নতাকে অজুহাত হিসেবে পেশ করবেন। এতে একমাত্র সন্ত্রাসীরাই লাভবান হবে এবং জাতি ভয়ঙ্কর সংঘাতের মধ্যে নিপতিত হবে।

আলোচিত তৃতীয় কারণ: ওহাবী মতবাদ

ওহাবী মতবাদ’-কে জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে অনেক গবেষক উল্লেখ করছেন। বর্তমান সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (১৭০৩-১৭৯২ খৃ) প্রচারিত মতবাদকেওহাবীমতবাদ বলা হয়। তিনি তৎকালীন আরবে প্রচলিত কবর পুজা, কবরে সাজদা করা, কবরে বা গাছে সুতা বেঁধে রাখা, মানত করা অন্যান্য বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার, শিরক, বিদআত ইত্যাদির প্রতিবাদ করেন। তাঁর বক্তব্য শুধু প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উপরন্তু তাঁর বিরোধীদের তিনি মুশরিক বলে অভিহিত করতেন। ১৭৪৫ খৃস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের অনতিদূরে অবস্থিত দিরইয়্যা নামক ছোট্ট গ্রাম-রাজ্যের শাসক আমীরমুহাম্মাদ ইবনু সাঊদ (মৃত্যু ১৭৬৫) তাঁর সাথে যোগ দেন। তাদের অনুসারীগণ তাদের বিরোধীদেরকে মুশরিক বলে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালন শুরু করেন। ১৮০৪ সালের মধ্যেই মক্কা-হিজায সহ আরব উপদ্বীপের অধিকাংশসাউদী’-‘ওহাবীদের অধীনে চলে আসে।

তৎকালীন তুর্কী খিলাফত এই নতুন রাজত্বকে তার আধিপত্য নেতৃত্বের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বলে মনে করেন। কারণ একদিকে মক্কা-মদীনা সহ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, অন্যদিকে মূল আরবে স্বাধীন রাজ্যের উত্থান মুসলিম বিশ্বে তুর্কী খিলাফতের একচ্ছত্র নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তুর্কী খলীফা দরবারের আলিমগণের মাধ্যমে ওহাবীদেরকে ধর্মত্যাগী, ধর্মদ্রোহী, কাফির ইসলামের অন্যতম শত্রহিসেবে ফাতওয়া প্রচার করেন। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারাভিযান চালানো হয়, যেন কেউ এই নব্য রাজত্বকে ইসলামী খিলাফতের স্থলাভিষিক্ত মনে না করে। পাশাপাশি তিনি তুর্কী নিয়ন্ত্রণাধীন মিসরের শাসক মুহাম্মাদ আলীকে ওহাবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন। মিশরীয় তুর্কী বাহিনীর অভিযানের মুখে ১৮১৮ সালে সউদী রাজত্বের পতন ঘটে। এরপর সাউদী রাজবংশের উত্তর পুরুষেরা বারংবার নিজেদের রাজত্ব উদ্ধারের চেষ্টা করেন। সর্বশেষ এই বংশেরআব্দুল আযীয ইবনু আব্দুর রাহমান আল-সাউদ (১৮৭৯-১৯৫৩) ১৯০১ থেকে ১৯২৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বর্তমানসৌদি আরর প্রতিষ্ঠা করেন।

খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মুসলিম বিশ্বের যেখানেই সংস্কারমূলক কোনো দাওয়াত প্রচারিত হয়েছে, তাকেই সৌদি ওহাবীগণ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত বাওহাবী আন্দোলনবলে দাবি করেছেন। অপরদিকে তুর্কী প্রচারণায়ওহাবীশব্দটি মুসলিম সমাজে অত্যন্ত ঘৃণ্য শব্দে পরিণত হয়। তাদেরকে অন্যান্য সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের চেয়েও অধিকতর ঘৃণা করা হয়। ফলে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বৃটিশ বিরোধী আলিমদেরকে ওহাবী বলে প্রচার করতেন; যেন সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকে। এছাড়া মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরকে নিন্দা করার জন্যওহাবীশব্দের ব্যাপক ব্যাবহার করেন।

মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের সমসাময়িক ভারতীয় মুসলিম সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (১৭০৩-১৭৬২ খৃ) তাঁর মত-প্রচারের প্রথম দিকে ১৭৩১ খৃস্টাব্দে তিনি মক্কায় গমন করেন এবং তিন বৎসর তথায় অবস্থান করেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি ভারতে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনিও কবর পূজা, পীর পূজা, কবরে মানত করা, কবরবাসী বা জীবিত পীর বা ওলীগণের কাছে বিপদমুক্তির সাহায্য চাওয়া অন্যান্য শিরক, বিদআত, কুসংস্কার, মাযহাবী বাড়াবাড়ি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা প্রতিবাদ করেন। এজন্য কেউ কেউ তাঁকেওহাবীবলে চিহ্নিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন।

তবে ভারতের সর্বপ্রথম সংবিধিবদ্ধ সুপ্রসিদ্ধওহাবীনেতা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীযের (১৩৪৬-১৮২৩ খৃ) অন্যতম ছাত্র সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (১৭৮৬-১৮৩১ খৃ) তিনি সমগ্র ভারতে মাযার, দরগা, ব্যক্তি পূজা, মৃত মানুষদের নামে মানত, শিন্নি ইত্যাদি বিভিন্ন শিরক, বিদআত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। এছাড়া তিনি বৃটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৮২১ খৃস্টাব্দে তিনি হজ্জে গমন করেন। প্রায় তিন বৎসর তথায় অবস্থানের পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৮২৬ খৃস্টাব্দে তিনি বৃটিশ ভারত থেকেহিজরতকরে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গমন করে সেখানেইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং নিজে সেই রাষ্ট্রের প্রধান হন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম সেখানে একত্রিত হয়ে বৃটিশ শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। কয়েকটি যুদ্ধের পরে ১৮৩১ খৃস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে তাঁর বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিনি শাহাদত বরণ করেন। পরবর্তী প্রায় ৩০ বৎসর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অনুসারীগণ বৃটিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার বিচ্ছিন্ন জিহাদ প্রতিরোধ চালিয়ে যান।

বৃটিশ সরকার সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করেন। তারা দাবি করেন যে, হজ্জ উপলক্ষে আরবে গমন করে তথাকার ওহাবীদের থেকে দীক্ষা নিয়েই তিনি তার সংস্কার জিহাদ আন্দোলন শুরু করেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর শিষ্যদের থেকে ভারতে বিভিন্ন সংস্কারমুখী ধারার জন্ম নেয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্য থেকে অনেকে নির্ধারিত মাযহাব অনুসরণ অস্বীকার করে নিজেদেরকেআহলে হাদীসবলে দাবি করেন। এছাড়া তাঁর শিষ্য জৌনপূরের পীর মাওলানা কারামত আলী একটি সংস্কারমুখী ধারার জন্ম দেন। ফুরফুরার পীর মাওলানা আবূ বাক্র সিদ্দীকীও সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর মতানুসারী তাঁর প্র-শিষ্য ছিলেন। এছাড়া দেওবন্দের আলিমগণও তাঁরই শিষ্যদের থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। এদেরর সকলকেই প্রতিপক্ষগণ, ঔপনিবেশিক সরকার সৌদি ওহাবীগণওহাবীবলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষত আহলে হাদীসগণ দেওবন্দের আলিমগণই এই উপাধি বেশি লাভ করেছেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর অন্যতম শিষ্য সমসাময়িক সংস্কারক মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমির (১৭৮২-১৮৩১) এবং সমকালীন অন্য সংস্কারক হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) এদেরকেও ওহাবী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এদের আন্দোলন প্রতিরোধকে ওহাবী আন্দোলন বলা হয়েছে।

বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপীইসলামী সন্ত্রাসবা জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন উসামা বিন লাদিনের মত সৌদি বংশোদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। সৌদি আরবের বিভিন্ন ব্যক্তি সংস্থা এদের অর্থায়ন করেন বলে শোনা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত উপমহাদেশে আহলে হাদীস দেওবন্দী-পদ্ধতির কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের এর সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়। এছাড়া এদের মধ্যে কবর-মাযার ইত্যাদির বিরোধিতা দেখা যায়। সর্বোপরি এরা নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য মৌখিক প্রচার ছাড়াও অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। এজন্য অনেক গবেষক মনে করেন যে, ওহাবী মতবাদের প্রসারই বর্তমান জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ।

তবে এখানে লক্ষণীয় যে, উসামা বিন লাদিন-এর আন্দোলন-এর গোড়া পত্তন হয় সৌদি-ওহাবী রাষ্ট্রের বিরোধিতার মাধ্যমে। তাঁর অনুসারীগণ তথাকার রাজতন্ত্র, মার্কিন সৈন্য, অনাচার ইত্যাদির বিরোধিতা করেন এবং সৌদি রাষ্ট্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম তাঁরা অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের বংশধরসহ সকল সৌদি ওহাবী আলিম বিন লাদিনের আন্দোলন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার।

সর্বোপরি, বিভিন্ন দেশের সংস্কারমূলক আন্দোলন বা প্রতিরোধ আন্দোলনকেওহাবীবলে আখ্যায়িত করার কোনো ভিত্তি নেই। বস্তুত মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব তাঁর আদর্শ প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব মর্যাদা লাভ করেছে তুর্কি খিলাফতের প্রচার বৃটিশ সরকারের সুযোগসন্ধানের কারণে। ওহাবী মতবাদ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একান্তই একটি আঞ্চলিক বিষয় ছিল। অন্যান্য মুসলিম দেশের সংস্কার-প্রতিরোধ ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মতই ভালমন্দ মেশানো একটি বিষয়। অন্যান্য দেশে মুসলিমগণ তাদের পরিবেশ প্রয়োজন অনুসারে অনুরূপ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। যেহেতু ওহাবীগণ অন্যান্য দেশের মুসলিমগণ সকলেই একই সূত্র, অর্থাৎ কুরআন, হাদীস, ইসলামী ফিক্হ ইসলামের ইতিহাস থেকে নিজেদের মতামত সংগ্রহ করেছেন, সেহেতু তাদের মতামত কর্মের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। জন্য সকল কৃতিত্ব মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবকে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।

আমরা জানি যে, আফগানিস্থান ইরাকে বিন লাদিনের মতবাদ বা জঙ্গিবাদ প্রসার লাভ করেছে। আর এই দুটি দেশই ঘোর ওহাবী বিরোধী। আফগানিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠি হানাফী মাযহাবের কঠোর অনুসারী, পীর মাশাইখদের ভক্ত এবং ওহাবীদের বিরোধী। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ শাসনামলে ওহাবী বা অন্য যে কোনো সংস্কারমুখী আলিম মতবাদকে কঠোরভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শুধুমাত্র পীর-মাশাইখ সূফীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোরতা অবলম্বন করা হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার থেকে বুঝা যায় যে, জঙ্গিবাদের কারণ অন্য কোথাও নিহিত রয়েছে।

আমরা আগেই দেখেছি যে, সন্ত্রাসীদের জাতি, ধর্ম গোত্র ইত্যাদিকে ঢালাওভাবেসন্ত্রাসেরকারণ বা চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সঠিক নয়। এতে সন্ত্রাস দমনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, কোনো, জাতি, ধর্ম বা গোত্রের সকল মানুষকে তো আর ঢালাওভাবে বিচার করা যায় না। জঙ্গিবাদের দায়িত্বওহাবী মতবাদেরউপর চাপানোর বড় বিপত্তি হলো, এসে সমস্যা সমাধানের পথ হারিয়ে যাবে। কেননা সৌদি ওহাবীদের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন, কারণ জঙ্গিবাদ তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত। আর অন্য কোনো দেশের কেউ নিজেকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না, কিন্তু প্রায় সকল ধর্মীয় দলই বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারাওহাবীবলে আখ্যায়িত।

আলোচিত চতুর্থ কারণ: ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র

বিশ্বের সর্বত্রই সাধারণ আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ইসলামী দলসমূহ জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করছেন এবং নিন্দা করছেন। সাধারণভাবে তাঁরা উপরের তিনটি কারণকে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ বলে স্বীকার করেন না। রবং তাঁরা দাবি করেন যে, ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই এই জঙ্গিবাদের উত্থান। ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, ইসলামী দেশগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নতি বন্ধ করতে এবং সকল দেশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতেই তারা গোপন অর্থায়নে কিছু মুসলিম যুবককে বিভ্রান্ত করে এরূপ জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছেন।

তাঁরা তাদের এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেন না, তবে অনেক যুক্তি পেশ করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, এই বোমাবাজি, অশান্তি, সন্ত্রাস এগুলি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি।সভ্যতার সংঘাতথিওরি আবিষ্কারের পূর্বে বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে কখনোই মুসলিম উম্মাহর মধ্যেজিহাদনামে এরূপ সন্ত্রাস কখনোই দেখা যায় নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোথাও কোনো মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে বা দলগত ভাবে কাউকে গুপ্ত হত্যা করেছে, কারো বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছে…. ইত্যাদির কোনো নযির আমরা দেখতে পাই না।সভ্যতার সংঘাতথিওরি আবিষ্কারের পরে পাশ্চাত্য বিশ্ব নিজ প্রয়োজনেই এই অবস্থা তৈরি করে নিয়েছে।

দীর্ঘ অর্ধ সহস্র বৎসর যাবৎ ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ইউরোপীয় খৃস্টানগণ। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পতন মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ক্রুসেডের সমাপ্তি হয়েছে বলে ধারণা করেছিলেন তারা। বিংশ শতাব্দির ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষত সেভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পরে তারা হিসাব নিকাশ পাল্টে ফেলেন। তারাসভ্যতার সংঘাতেরথিওরী উপস্থাপন করেন। তারা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন যে, মুসলিম বিশ্বকে তার নিজের গতিতে অগ্রসর হতে দিলে ২১শ শতকের প্রথমার্ধেই মুসলমানগণবিশ্ব শক্তিতেপরিণত হবে। অর্থনৈতিক স্থিতি, প্রযুক্তিগত শক্তি সমর শক্তিতে তারা শক্তিশালী হয়ে যাবে এবং তাদেরনাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোরকোনো সুযোগ থাকবে না। মুসলিম উম্মাহকে ঠেকাতে হলে তাদেরকে আঘাত করতে হবে।

কিন্তু আঘাত তো কোনোকারণছাড়া করা যায় না। স্বভাবতই কোনো মুসলিম দেশই পাশ্চাত্যের সাথে কোনো সংঘাতে যেতে রাজি নয়। কিন্তু সংঘাত না হলেও তো কাজ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বিশেষত দুর্বলকে সংঘাতের মধ্যে নামাতে পারলে বিজয় নিশ্চিত থাকে। এজন্যই তাঁরা এই জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছেন।

সকল মুসলিম পণ্ডিত আফগান জিহাদকে অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেন। সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে আফগানিস্থানের মুসলিম জনগোষ্ঠি প্রতিরোধ শুরু করে। আমেরিকা এই সুযোগে সকল প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র, ট্রেনিং, প্রযুক্তি সকল প্রকার সাহায্য দিয়ে এগিয়ে নেয়। সারা বিশ্বে এদের পক্ষে প্রচার চালায়। এরপর তারা তাদেরকে উস্কানির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করে। তারা বেপরোয়া হয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন। পরিত্যক্ত উত্তেজিত সকল মানুষ আবেগ তাড়িত হয়েও অনেক কাজ করতে থাকেন। এছাড়া সকলমুজাহিদদের মধ্যে আমেররিকার নিজস্ব অনুচর রয়েছে। যারা এদেরকেসংঘাতের পথেযেতে প্ররোচিত করছে। এরা জিহাদ কিতাল বিষয়ক আয়াত হাদীসগুলির অপব্যাখ্যা করে মুসলিম উম্মাহকেপ্রিম্যাচিউরডসংঘাতের পথে যেতে উস্কানি দিচ্ছে। এভাবে সারা মুসলিম বিশ্বেজিহাদেরবিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।

ইসলামপন্থীদের এই দাবির যুক্তি যত জোরালোই হোক তার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এছাড়া এই দাবিও সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সহায়তা করে না। সর্বোপরি, শত্রতো শত্র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেই। যদি কেউ সত্যিই ইসলামের শত্রহন তবে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য তাঁদের দোষ দেওয়া বা তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা অর্থহীন কর্ম। আমাদের দেখতে হবে কি কারণে মুসলিম যুবকগণ তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। কারণগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিকার না করতে পারলে আমাদের দোষারোপ প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাঁদের ষড়যন্ত্র সফলতা লাভ করবে।

উপরের আলোচনা থেকে আমাদের নিকট প্রতিভাত হয় যে, উপর্যুক্ত চারিটি বিষয়কে বাদ দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান প্রসারের পিছনে কার্যকর অন্যান্য কারণ সন্ধান করা আমাদের প্রয়োজন। বস্তুত ইসলামের নামে সন্ত্রাসের উত্থানের পিছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। কোনো বিষয় সন্ত্রাস উস্কে দিচ্ছে, কোনো কোনো বিষয় জঙ্গিবাদীরের প্রচারণা ইসলাম-প্রেমিক সরল-প্রাণ যুবক-যুবতীদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারছে। কারণগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিকার করতে পারলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে তা সহায়ক হবে বলে মনে হয়। এগুলির মধ্যে কিছু কারণ সৃষ্টি করেছেন অমুসলিমগণ এবং কিছু কারণ সৃষ্টি করেছেন মুসলিমগণ। মুসলিম সৃষ্ট কারণগুলির মধ্যে কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক এবং কিছু ধর্মীয়। এখানে এই জাতীয় কিছু সাম্ভব্য কারণ আলোচনা করছি।

() বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন

ইসলামের নামে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রধান কারণ বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের উপর নির্বিচার অত্যাচার হত্যাযজ্ঞ। ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চীন অন্যান্য বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্বিচার জুলুম, অত্যাচার জাতিগত নিধনযজ্ঞ ethnic cleansing) চলছে। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের অদম্য আবেগই জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে। মানুষ যখন নির্বিচার অত্যাচারের প্রতিবাদে আইনগতভাবে কিছুই করতে না পারে তখন বে-আইনীভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করে এবং তার বে-আইনী কর্মকেআদর্শিকছাপ দেয়। এছাড়া সারা বিশ্বের মুসলিম মানস এই নিধনযজ্ঞের অবসান মুসলিম সভ্যতার বিজয় কামনা করছে। জঙ্গিবাদীরা এদেরকে সহজেই বুঝাতে পারছে যে, তাদের পথই নিধনযজ্ঞের অবসানের বিজয়ের পথ। এক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-বিধান বিচার, আলিমদের মতামত, ফলাফলের বিচার ইত্যাদির চেয়ে আবেগই বেশি কার্যকর।

মার্কিন সরকারের হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ গ্রহণ বা জুলুমের প্রতিকার করতে আবেগী যুবক সাধারণ মার্কিন নাগরিককে বা মার্কিনীদের সাথে সহযোগী বলে অন্য কোনো দেশ ধর্মের কোনো মানুষকে হত্যা করেন। এভাবে তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে একটি কঠিন অন্যায় পাপের মধ্যে নিপতিত হন।

এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়: () ইসলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ অন্যায় পদ্ধতিতে করতে অনুমতি দেয় না। () ইসলাম একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি প্রদানের অনুমতি দেয় না, () ইসলাম কোনো ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠিকে বিচার বা শাস্তির দায়িত্ব নিজে গ্রহণের অনুমতি দেয় না। এজন্য প্রাজ্ঞ আলিমগণ সকল ক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে, শান্তিপূর্ণভাবে সহিংসতা বর্জন করে প্রতিবাদ নিন্দা জ্ঞাপনের উৎসাহ দেন। কিন্তু আবেগী যুবকের কাছে তাদের মত দুর্বলতা বা দালালি বলে মনে হয়। এই পরিস্থিতিতেআধুনিক অর্ধ-আলিম ধর্মগুরুদের’ ‘ফাতওয়াতাদের কাছে যুগোপযোগী, সঠিক দ্রুত ফললাভের সহায়ক বলে মনে হয়। এভাবেই জঙ্গিবাদের উত্থান প্রসার ঘটতে থাকে।

() বেকারত্ব হতাশা

উপরের ক্ষোভ সকল মুসলিম দেশে বিদ্যমান থাকলেও জঙ্গিবাদী কার্যক্রম সকল দেশে সমানভাবে বিস্তার লাভ করেনি। ইন্দোনেশিয়ায় যেরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়, মালয়েশিয়াতে তা পাওয়া যায় না, অথচ ইসলামী শিক্ষার বিস্তার, মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য এবং আমেরিকা পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাবে মালয়েশিয়াতে বেশি। এর বড় কারণ সম্ভবত মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পাশ্চাত্য আগ্রাসনের বিরুদ্বে রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের সুস্পষ্ট মতামত। কর্মব্যস্ত পরিতৃপ্ত মানুষের মনে ক্ষোভ বা আবেগ বেশি স্থান পায় না। এছাড়া রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে তাদের মনের আবেগ প্রতিধ্বণিত হয়। ফলে তা প্রকাশের জন্য বিকৃত পথের সন্ধান করে না। পক্ষান্তরে বেকার, সামাজিক বৈষম্য বা প্রশাসনিক অনাচারের শিকার মানুষের মনের ক্ষোভ হতাশাকে সকল আবেগ আরো উস্কে দেয়। এছাড়া এইরূপ মানুষকে সহজেই বুঝানো যায় যে, এভাবে দুই-চারিটি বোমা মারলে বা মানুষ খুন করলেই তোমর মত অগণিত মানুষের বেকারত্ব বা অত্যাচার শেষ হয়ে শান্তির দিন এসে যাবে।

() আধুনিক অর্ধ-আলিম ধর্মগুরুদের উত্থান

কুরআনের পরিপূর্ণ অধ্যয়ন, বিশাল হাদীস ভাণ্ডারের সকল হাদীস অধ্যয়ন, রাসূলুল্লাহ (r)-এর সহচর-সাহাবীগণের কর্ম, চিন্তা, মতামত কুরআন-হাদীস ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া অধ্যয়ন সমস্যা সমাধানে সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর নেতৃস্থানীয় আলিম, ফকীহ ইমামদের মতামত কর্মধারা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের পরেই একজন মানুষ প্রকৃত আলিম ফকীহ বলে গণ্য হন এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রিয় সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলামীফাতওয়াবা সিদ্ধান্ত সমাধান দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। যুগে যুগে এরূপ আলিমগণই মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। স্বভাবতই এরূপ আলিমদের সংখ্যা সমাজে কম থাকে। এজন্য মুসলিম উম্মাহর আলিমগণের রীতি হলো, জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে সমকালীন প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি পূর্ববর্তী প্রখ্যাত আলিমগণের মতামতের অনুসন্ধান তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত প্রদান।

ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস কুরআন হাদীস। যে কোনো ব্যক্তি কুরআন-হাদীস পাঠ করলে ইসলাম সম্পর্কে অনেক জ্ঞান লাভ করবেন। ইসলাম সকলকেই এভাবে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করতে নির্দেশ উৎসাহ প্রদান করে। কিন্তু কখনোই সকলেইফাতওয়াবা সিদ্ধান্ত প্রদানের অনুমতি দেয় না। শুধু কুরআনের কিছু আয়াত বা কিছু হাদীস পাঠ করে নিজের বুদ্ধি আবেগের রঙে রঞ্জিত করেফাতওয়া’, সিদ্ধান্ত বা সমাধান প্রদান করার প্রবণতা ভয়ঙ্কর।

ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জঙ্গিবাদী ঘটনার মূল কারণ ছিল এই প্রবণতা। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খৃ) ইসলামী রাষ্ট্্েরর খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হযরত উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। বিদ্রোহীদের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মত কেউ ছিল না। তাঁরা রাজধানী মদীনার সাহাবীগণকে বিষয়ে চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে হযরত আলী (রা) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাপতি গভর্নররগণ আলীর আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু হযরত উসমান (রা) নিযুক্ত সিরিয়ার গভর্নর হয

৯২৬

কোন তথ্যসূত্র নেই

আপনার জন্য প্রস্তাবিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশন

To preach and propagate the values and ideals of Islam, the only complete code of life acceptable to the Almighty Allah, in its right perspective as a religion of humanity, tolerance and universal brotherhood and bring the majority people of Bangladesh under the banner of Islam

অফিসিয়াল ঠিকানা: অফিসিয়াল ঠিকানা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শের-এ- বাংলা নগর, ঢাকা -১২০৭